চট্টগ্রাম কারাগারে বড় দুশ্চিন্তা পাইলস রোগী, ভুগছে বন্দিদের এক-তৃতীয়াংশই

৬ হাজার বন্দির জন্য ২ ডাক্তার ও ২ নার্স, যন্ত্রপাতিও বিকল

চট্টগ্রাম কারাগারের হাসপাতালে বন্দিদের জন্য নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা। প্রায় ছয় হাজার বন্দির জন্য আছে মাত্র ২ জন ডাক্তার ও ২ জন নার্স। রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতিও চালানোর মানুষের অভাবে বিকল হয়ে আছে। ফলে পাইলস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, প্যারালাইসিস, যক্ষ্মা ও মানসিক রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্তরা পাচ্ছে না সুচিকিৎসা। এর মধ্যে বন্দিদের এক-তৃতীয়াংশই পাইলসে আক্রান্ত। এদের বেশিরভাগই শুরুতে চিকিৎসা না পাওয়ায় তাদের বসতে হচ্ছে অপারেশনের টেবিলে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসব রোগীর জন্য ‘প্রিজন সেল’ থাকলেও তাদের চিকিৎসা নিতে হয় অন্য ওয়ার্ডে।

এছাড়া প্রয়োজনীয় ওষুধের পাশাপাশি কারাগারে নেই পর্যাপ্ত খাবার পানির ব্যবস্থা। পর্যাপ্ত পানি না খাওয়ার ফলে বন্দিদের পাইলসের সমস্যা আরও গুরুতর হয়ে ওঠে। একদিকে সুচিকিৎসার অভাব অন্যদিকে পর্যাপ্ত খাবার পানি না থাকা— সবমিলিয়ে কারাগারের হাসপাতালটি নানা সমস্যায় জর্জরিত।

জানা গেছে, খাবার পানির সংকটের কারণে কারাগারে বন্দি পাইলস রোগীদের বিপদে পড়তে হয়। কারণ পাইলস রোগীদের পর্যাপ্ত পানি পান করতে হয়। কিন্তু কারাগারে পানির সংকট থাকায় তা সম্ভব হয় না। দীর্ঘদিন ধরেই কারাগারে রয়েছে পানির সমস্যা। কারাগারের ছয়টি ভবনের মধ্যে চারটি ভবনে সরবরাহ লাইনে ত্রুটির কারণে পানি সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। দৈনিক সোয়া ৪ লাখ লিটার পানির চাহিদা থাকলেও দেওয়া হচ্ছে মাত্র ২ লাখ লিটার।

এছাড়া চট্টগ্রামের মানুষের খাদ্যাভাসও এ রোগের পেছনে দায়ী। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ লাল মাংস বেশি খান। ফলে কারাগারে যাওয়ার আগ থেকে এ রোগে আক্রান্ত হন। আর কারাগারে গেলে সেখানে পর্যাপ্ত সুচিকিৎসার অভাবে এ রোগ বড় আকার ধারণ করে।

মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত চট্টগ্রাম কারা হাসপাতালে ৮০ জন বন্দি চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে নারী বন্দি ৪ জন, বাকি ৭৬ জনই পুরুষ। কারা হাসপাতালে ক্যান্সারের রোগী আছেন ৫ জন। এছাড়াও রয়েছেন হৃদরোগ, স্ট্রোক, প্যারালাইসিস, যক্ষ্মা ও মানসিক রোগীও। কিন্তু এসব রোগীর মধ্যে ইনডোরে পাইলস রোগীর ভিড় বেশি। এছাড়া হাসপাতালের বহির্বিভাগেও প্রতিদিন অসংখ্য পাইলসের রোগী আসেন চিকিৎসা নিতে। এদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে অন্য রোগীদের চিকিৎসায় হিমশিম খেতে হয় ডাক্তারদের।

এখানে পাইলস রোগীদের সুচিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না বলে জানিয়েছেন কারা হাসপাতালের ডাক্তার।

চট্টগ্রাম কারাগার হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শামীম রেজা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পাইলস রোগের বিভিন্ন গ্রেড থাকে। সে গ্রেড অনুযায়ী রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। প্রথম গ্রেডে যারা আক্রান্ত, তাদের পাইলসে আক্রান্ত রক্তনালীর কুশনগুলি মলদ্বারের মধ্যেই ঢুকে থাকে। যেটি ওষুধে সেরে যায়। কিন্তু এর পরের তিনটি গ্রেডে অপারেশনের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে দ্বিতীয় গ্রেডের রোগীরা মলত্যাগ করতে গেলে মলদ্বার যখন বাইরে চলে আসে, তা এমনিতেই ভেতরে ঢুকে যায়। তৃতীয় গ্রেডের রোগী মলত্যাগের জন্য চাপ দিলে মলদ্বারের বাইরে বের হয়ে আসে, যা আঙুলের চাপ দিয়ে পুনঃস্থাপন করে দিতে হয়। চতুর্থ গ্রেডে মলদ্বারের বাইরে বের হয়ে আসা পাইলস কোনো অবস্থাতেই পুনঃস্থাপন করা যায় না।’

ডা. শামীম রেজা বলেন, ‘প্রথম গ্রেড ছাড়া পরের তিনটি গ্রেডে আক্রান্ত পাইলস রোগীদের অপারেশন করতে হয়। অপারেশন না করলে ব্লিডিং হতে থাকে মলত্যাগের সময়। যা একসময় ক্যান্সারে রূপ নেয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ছয় হাজার বন্দির মধ্যে যেসব বন্দি বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন, তাদের এক-তৃতীয়াংশই পাইলস রোগী। এসব রোগী শুরুতেই ব্লিডিংয়ের সমস্যা নিয়ে আসেন। প্রতিদিন বহির্বিভাগে গড়ে ২৫০ বন্দি রোগী নানা রোগে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। এদের সঙ্গে পাইলস রোগীদের সঠিক চিকিৎসা দেওয়া অনেক দুরূহ।’

পাইলস ব্লিডিংয়ের রোগীদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয় জানিয়ে কারা হাসপাতালের এই আবাসিক চিকিৎসক বলেন, ‘পাইলসের চিকিৎসা অতোটা স্মুথ না। কারাগারের নিয়মকানুন মেনে কারারক্ষীদের দিয়ে যখন মেডিকেলে পাঠানো হয়, ততদিনে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। হাসপাতালে ভর্তির পরপরই প্রয়োজন হয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার। কিন্তু সেটি মেডিকেলের ল্যাব থেকে করাতে হয়। তারপর শুরু হয় চিকিৎসা।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, একটি প্রিজন সেল থাকলেও সেখানে বন্দি রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয় না। কারণ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রিজন সেলে আসতে চান না। ফলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে পাহারায় রেখে চিকিৎসা নিতে হয় অন্যান্য বন্দি রোগীদের মত পাইলস রোগীদেরও।

মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম মেডিকেলের ২৫ ও ২৭ নম্বর সার্জারি ওয়ার্ডে কারাগার থেকে আসা বন্দি পাইলস রোগী দেখা গেছে।

২৭ নম্বর সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. জামশেদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘সার্জারিতে যেসব পাইলস রোগী আছেন, তাদের বেশিরভাগের ব্লিডিং থাকে। রোগীর রক্তশূন্যতাও থাকে। কারও কারও কিডনি, ডায়াবেটিকসের সমস্যাও থাকে। এসব রোগীকে অপারেশন করে রিকভারি করা কঠিন।’

তিনি আরও বলেন, ‘পাইলস রোগীদের রোগ নির্ণয় অনেক দেরিতে হয়ে থাকে কারা হাসপাতালে। পাইলসের গ্রেড প্রাথমিক অবস্থায় বোঝা গেলে চিকিৎসা দিতে সহজ হয়।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!