চট্টগ্রাম কারাগারে পানির জন্য হাহাকার, বন্দিদের শরীরে ছড়াচ্ছে চর্মরোগ স্ক্যাবিস

পানি নিয়ে ওয়াসা—গণপূর্তের গ্যাড়াকলে কারাবন্দিরা, সপ্তাহে একদিন পানি মেলে

চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় কারাগারে পানি নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বন্দিদের। প্রতিদিন প্রায় ছয় হাজার বন্দির জন্য চার লাখ লিটার পানির প্রয়োজন হলেও চট্টগ্রাম ওয়াসা ও গণপূর্ত মিলে বর্তমানে সরবরাহ করছে মাত্র এক লাখ ৮৪ হাজার লিটার। সে হিসেবে বন্দিরা সপ্তাহে মাত্র একদিন গোসল করার সুযোগ পান। এছাড়া কাপড় পরিষ্কারও করতে পারেন না ঠিক মতো। খাবার পানিও তাদের খেতে হয় কিনে। আর এতে করে স্ক্যাবিসসহ নানা ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে কারাবন্দিরা।

তবে কারাগার গণপূর্তের আওতায় তৈরি হওয়ায় পানির চাহিদা মেটানোও দায় তাদের বলে জানায় ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। একইসঙ্গে কারা কর্তৃপক্ষের বিল বকেয়া রাখার বিষয়টিও জানান তিনি। তার মতে, কারা কর্তৃপক্ষ যদি এককভাবে ওয়াসার সঙ্গে চুক্তি করে এবং বিল ঠিক মতো পরিশোধ করে তাহলে পানির চাহিদা সহজেই মেটাবে তারা।

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত বন্দির সংখ্যা ছয় হাজারের কিছু বেশি বলে জানায় কারা কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে গড়ে ছয় হাজার বন্দির জন্য চার লাখ লিটার পানির প্রয়োজন হলেও প্রতিদিন পাওয়া যাচ্ছে এক লাখ ৮৪ হাজার লিটার। এরমধ্যে দেড় লাখ লিটার পানির যোগান দিচ্ছে ওয়াসা। বাকি ৩৪ হাজার লিটার দিচ্ছে গণপূর্ত-২। এর মধ্যে কারাগারের বন্দি ছাড়াও ভেতরে সিঙ্গেল স্টাফ ব্যারাকে ২২৫ জন কারারক্ষী ও চারটি ফ্যামেলি কোয়ার্টারের বসবাসরত এক হাজার লোকের পানির যোগানও ওই এক লাখ ৮৪ হাজার লিটার থেকে করা হয়।

ওয়াসার তথ্যমতে, রাঙ্গুনিয়ার শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার ফেইজ-১ থেকে দৈনিক ১৪ কোটি ৩০ লাখ লিটার, মোহরা পানি শোধনাগার থেকে ৯ কোটি লিটার, শেখ রাসেল পানি শোধনাগার থেকে ৯ কোটি লিটার এবং ৩২টি গভীর নলকূপ থেকে তিন কোটি ৪০ লাখ লিটার পানি উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।

সর্বশেষ শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার প্রকল্প ফেইজ-২ উৎপাদনে এসেছে। এই প্রকল্পের সক্ষমতা ১৪ কোটি ৩০ লাখ লিটার। চট্টগ্রাম ওয়াসার ৪টি প্রকল্প ও গভীর নলকূপ থেকে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পানি উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। সব মিলিয়ে ওয়াসা দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পানি সরবরাহের সক্ষমতা অর্জন করেছে। অন্যদিকে বর্তমানে ওয়াসার দৈনিক ৪০ থেকে ৪২ কোটি লিটার পানির চাহিদা রয়েছে। সে হিসাবেও দৈনিক আট কোটি লিটারের বেশি পানি উদ্বৃত্ত থাকার কথা।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) তথ্য অনুযায়ী, কারাগারে ৯ হাজার বন্দীর জন্য দৈনিক পানি প্রয়োজন ছয় লাখ ৩০ হাজার লিটার। আর ছয় হাজার বন্দির জন্য পানির দরকার চার লাখ ২০ হাজার। যা জনপ্রতি বন্দি হিসেবে ৩৫ লিটার হয়।

আরও জানা গেছে, গণপূর্ত থেকে দুটি ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়েছিল কারাগারে। কিন্তু একটি টিউবওয়েলের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেটি থেকে বর্তমানে পানি ওঠে না। আর যে একটি রয়েছে, সেটিও মাঝে মাঝে নষ্ট থাকে। প্রতিদিন ওই একটা ডিপ টিউবওয়েল থেকে দৈনিক গড়ে ৩৪ হাজার লিটার পানি সরবরাহ করা হয়।

এছাড়া ওয়াসা থেকে কারাগারে দুটি দুই ইঞ্চি পানির লাইন স্থাপন করা হয়েছে। গত সপ্তাহে স্থাপন করা হয়েছে আরও দুটি। মোট চারটি মিলে রিজার্ভারে জমা হয় দেড় লাখ লিটার পানি।

চট্টগ্রাম গণপূর্ত-২ অফিস সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কারাগারে গণপূর্তের চারটি পানির রিজার্ভার আছে। যেখানে ৯ লাখ লিটার পানির ধারণক্ষমতা রয়েছে।

তবে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, কারাগার কর্তৃপক্ষ ওয়াসার ওপর নির্ভর করতে রাজি না। তারা চায়, গণপূর্তই কারাগারের পানির যোগান দিক। ওয়াসার সংযোগ নিয়ে ওয়াসাকে বিল পরিশোধের ঝামেলায় যেতে চান না তারা।

চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম কারাগার গণপূর্তের আওতাভুক্ত একটা স্থাপনা। যেহেতু গণপূর্ত এটি নির্মাণ করেছে, তাই পানির যোগান গণপূর্তেরই করার কথা।’

তিনি বলেন, ‘ওয়াসা কারাগারে চাহিদার অর্ধেকের মত পানি সরবরাহ করছে। কিন্তু ওয়াসার পনির বিল কারা কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো পরিশোধ করে না। কিছুদিন আগে পানির লাইন স্থাপনে যে খরচ হয়েছে তাও পরিশোধ করেনি।’

একেএম ফজলুল্লাহ আরও বলেন, ‘আমরা চাইলেই চট্টগ্রাম কারাগারের পানির সমস্যা এক নিমিষেই সমাধান করতে পারি। কিন্তু করছি না, এর কারণও আছে। আমরা গণপূর্তের সঙ্গে থেকে কোনো কাজ করতে চাই না। ওয়াসাকে পুরো দায়িত্ব দেওয়া হোক। কারাগার কর্তৃপক্ষ ওয়াসার বিল ঠিকমতো পরিশোধের একটা সম্মতিতে আসুক, আমরা ছয় হাজার বন্দির জন্য প্রতিদিন চার লাখ লিটার পানির ব্যবস্থা করব। এখন করছি দেড় লাখ লিটার, বাকিগুলো ওয়াসার জন্য কঠিন কিছু নয়।’

এদিকে গণপূর্ত কারাগারে ওয়াসার পানির সরবরাহের সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম গণপূর্ত-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘গত সপ্তাহে গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবুল খায়ের চট্টগ্রাম কারাগারে পানির যোগানের বর্তমান অবস্থা দেখতে যান। আরও একটি টিউবওয়েল স্থাপন করা যায় কি-না তা দেখেন। এখন টেস্ট টিউবওয়েল স্থাপন করে সুপেয় পানির স্তর পরীক্ষা করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমান সময়ে ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করে পানির স্তর পাওয়া সহজ বিষয় নয়। কারণ ৯০০ থেকে ১০০০ ফিট এর মধ্যে বালুর স্তরে পানি থাকে। আমরা পরীক্ষামূলকভাবে একটা ডিপ টিউবওয়েল স্থাপনের জন্য ১১০০ ফিট খনন করে দেখেছি, ১ হজার ফিট এর মধ্যে পানির লেয়ার আছে কিনা। আমরা ১০০০ ফিটে বালির স্তর পেয়েছি। এখন এ বালির নমুনা চুয়েটে পাঠানো হবে। চুয়েট থেকে সার্টিফাইড রেজাল্ট আসলে আমরা কারা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন চাইব।’

টেস্ট টিউবওয়েল স্থাপনে গণপূর্তের খরচ হচ্ছে দু’লাখ টাকা। আর চুয়েট থেকে অনুমোদন আসতেও মাসখানেক সুময় লাগবে বলে জানান নির্বাহী প্রকৌশলী অভিজিৎ চৌধুরী।

পানি সংকট নিয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেলসুপার গিয়াস উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কারাগারে গণপূর্ত নাকি ওয়াসা পানির যোগান দেবে, সেটা তাদের ব্যাপার। আমরা যে পানি রিজার্ভারে পাব, সেটাই বন্দিদের মধ্যে বন্টন করব।’

তবে ওয়াসার পানির বিল বকেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগে অডিটে আপত্তি তোলার পর কিছু টাকা বকেয়া দেখানো হয়েছিল। সেটা পরিশোধের দায়ভারতো আমার না।’

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শামীম রেজা বলেন, ‘হাইজেনিক মেনটেইন না করলে চর্মরোগ হতে পারে। কারাগারে ঘনবসতি আর পানির সমস্যাটা কারণে বেশিরভাগ বন্দীর স্ক্যাবিস চর্মরোগটি হচ্ছে। আমরা ট্রিটমেন্ট দিই, কিন্তু সেরে গিয়ে রোগটি আবারও হয়।’

বন্দিদের মধ্যে স্ক্যাবিসে আক্রান্তের সংখ্যা কেমন—এ প্রশ্নের উত্তরে শামীম রেজা বলেন, ‘ভালোই আক্রান্ত। আসলে রোগীর এসব রোগ নিরাময়ের জন্য থাকার জায়গা ও পানির সংস্থান হওয়া জরুরি।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!