চট্টগ্রাম কলেজে ১ বছরে সংঘর্ষ অর্ধশতাধিক, কথায় কথায় মারামারি-শক্তি প্রদর্শন
প্রভাব পড়ছে আশপাশের ৬ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও
একসময় যে চট্টগ্রাম কলেজ আলোচনায় আসতো মেধাবী শিক্ষার্থীদের সোনালী সাফল্যের জন্য, সেই চট্টগ্রাম কলেজ এখন বারবারই আলোচনায় আসছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-রাজনৈতিক হানাহানির জন্য। এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধু গত একবছরেই সবমিলিয়ে অন্তত অর্ধশতাধিকবার ছোট-বড় মারামারি হয়েছে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে কেন্দ্র করে। কারণে-অকারণে, সামান্য বিষয়েও নিজেদের গ্রুপের শক্তি প্রদর্শনে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়াচ্ছে কলেজের নেতাকর্মীরা।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) কলেজের সরস্বতী পূজার দিনেও দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় বহিরাগতের সঙ্গে কলেজের নেতাদের। এর দু’দিন পর রোববার (২৯ জানুয়ারি) ফের সংঘর্ষে জড়ায় কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুল করিম ও সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক সবুজের অনুসারীরা।
ফলে ইমেজ সংকটে পড়েছে চট্টগ্রামের মেধাবীদের শীর্ষ শিক্ষাস্থল হিসেবে পরিচিত শত বছরের চট্টগ্রাম কলেজ। কলেজের ছাত্রলীগ নেতাদের মারামারিতে অতিষ্ট কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অভিভাবকরাও। তাদের অনেকেই প্রশ্ন রাখছেন, চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের লাগাম টানবে কে?
চট্টগ্রাম কলেজে এক বছরের জন্য ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হলেও সেটি চলছে পাঁচ বছর ধরে। এই সময়ের মধ্যে তারা মারামারি, থানায় মামলা, সমোঝোতা ছাড়া তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম দেখাতে পারেনি। এরমধ্যে একবার সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত রাখার জন্য লিখিত নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। কমিটি ঘোষণার দু’মাস পর ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি রেজয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই নির্দেশ দেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির নিরিখে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কলেজ ক্যাম্পাসে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হল।
পরে কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের কোনো বিজ্ঞপ্তি না দিলেও চলতেই থাকে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের মারামারি।
এক বছরে অর্ধশতাধিক সংঘর্ষ
গত বছর অন্তত অর্ধশতাধিকবারেরও বেশি ছোট-বড় মারামারিতে জড়িয়েছে কলেজটির বিবাদমান দুই গ্রুপ। কলেজকেন্দ্রিক আধিপত্য, ক্ষমতা প্রদর্শন ছাড়াও হাস্যকর ছোট বিষয়েও মারামারি করেন তারা। ‘পান থেকে চুন খসার’ আগেই কলেজ শিক্ষার্থীদের শরীর থেকে ঝরে রক্ত। বিভাগের পিকনিক, প্রেমিকাবিষয়ক ঝামেলা, সালাম না দেওয়ার মতও অপরাধের কারণেও মারামারি করেন নগরীর শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা।
এমনকি কলেজের ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে নাস্তার ভাগাভাগি ও বক্তব্য প্রদানকে কেন্দ্র করেও মারামারি করতে দেখা যায় নেতাদের। যার ফলে একদিকে যেমন হাসির খোরাকে পরিণত হচ্ছে সংগঠনটি অন্যদিকে শিক্ষার মান হারাচ্ছে কলেজটি।
রোববার (২৯ জানুয়ারি) পরিসংখ্যান বিভাগের পিকনিকের দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়কে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয় কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অনুসারীদের। সংঘর্ষে রক্ত ঝড়িয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দু’জন। এর দু’দিন আগেও সরস্বতী পূজার দিন সংঘর্ষে মাথাফেটে হাসপাতালে যেতে হয় কলেজের একাধিক শিক্ষার্থীকে।
অসহায় কলেজ প্রশাসন ও পুলিশ
বারবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়ালেও এখনো কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি কলেজ প্রশাসনকে। শুধুমাত্র সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ‘ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ বলা ছাড়া আর কোনো কিছুর হদিস মেলেনি এখনও।
এক বছরে অর্ধ শতাধিক সংঘর্ষের বিষয়টি স্বীকার করে কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. মোজাহেদুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আসলে মারামারি হচ্ছে, তা অস্বীকার করার অবকাশ নেই।’
পিকনিক নিয়ে ও সরস্বতী পূজায় মারামারির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওগুলো এখনও গরম-গরম ইস্যুতো, তাই ক’দিন পর ব্যবস্থা নেবো।’
আগের ইস্যুগুলোতে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আসলে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, আমরা চাইলেও সবকিছু করতে পারি না। তবে আমরা তাদের ডেকে বুঝিয়ে মিলমিশ করিয়ে দিই। যাতে পরবর্তীতে এগুলো আর না করে। ওদের আমরা নিয়মিত কাউন্সিলিং করি।’
একই সুরে কথা বলেছেন চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মন্জুর কাদের মজুমদার। তিনি বলেন, ‘ওরা ছাত্র, তাই চাইলেও ওদের বিষয়ে বড় অ্যাকশন নেওয়া যায় না। তবে আমরা কলেজ ও আশপাশের পরিবেশ ঠিক রাখতে নিয়মিত টহল জোরদার করেছি। দুই গ্রুপের নেতাদের ডেকে কাউন্সিলিং করছি, কলেজ প্রশাসনকেও বুঝাতে বলেছি।’
কলেজকেন্দ্রিক মারামারিতে ছুরি, কিরিচের মতো অস্ত্র প্রদর্শনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছি। যারাই অস্ত্রের ব্যবহার করছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।’
কী ভাবছে নগর ছাত্রলীগ?
এখনও পর্যন্ত বারবার গণমাধ্যমে খবরের খোরাক হলেও নগর ছাত্রলীগ একবারও ব্যবস্থা নেয়নি চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের ওপর। শুধুমাত্র দায়সারা কথা বলেই বাঁচতে চান নগর ছাত্রলীগের দায়িত্বশীল নেতারা।
চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর বলেন, ‘আমরা এসব বিষয়ে একটা তদন্ত কমিটি করবো, দেখবো কারা এসব বিশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত। সামনে আমরা কলেজের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করবো। তাতে বিশৃঙ্খলাকারীদের বাদ দেওয়া হবে।’
কলেজের নেতারা যা বললেন
কলেজের সামগ্রিক বিষয়ে কথা হয় কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুল করিম ও সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক সবুজের সঙ্গে। তারা জানান, সামান্য ভুল বোঝাবুঝি থেকেই কলেজের জুনিয়ররা বিষয়টিকে বড় করে তোলে। অনেক সময় কলেজের বাইরের ঘটনাকেও চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের মারামারি বলে অপপ্রচার চালানো হয়।
এই বিষয়ে সভাপতি মাহমুদুল করিম বলেন, ‘কলেজে প্রায় ২২ হাজার শিক্ষার্থী আছে। তারা যদি বাইরে ব্যক্তিগত কারণে মারামারি করে, তবে তার দায়ভার কেন আমরা নিতে যাবো? হ্যাঁ, আমাদের রাজনৈতিক কারণে দু’একবার মারামারি হয়েছে, তবে যেভাবে ঢালাওভাবে বলা হচ্ছে; তেমনটা মোটেও না। বাইরের বিছিন্ন ঘটনাকেও অনেক সময় কলেজের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়।’
২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ২৫ সদস্যের কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করে নগর ছাত্রলীগ। কমিটি ঘোষণার পরেরদিনই পদত্যাগ করেন সাত সদস্য। এছাড়াও কলেজটির ছোট কমিটিতে বহিরাগত ছাত্র, বয়স্ক, রাজনীতি না করা ছেলেকে নেতা বানিয়ে ক্ষোভের মুখে পড়েন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক।
প্রভাব পড়ছে আশপাশের ৬ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে
চট্টগ্রাম কলেজের আশপাশে অল্প দূরত্বে রয়েছে সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, কাজেম আলী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সরকারি মহসিন স্কুল, চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়সহ আরও একাধিক নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
চট্টগ্রাম কলেজে সংঘর্ষের প্রভাব পড়ছে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ওপর। মারামারিতে যান চলাচল বন্ধসহ আতঙ্কে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের।
তবে সব থেকে ভয়াবহ হচ্ছে, নিজেদের গ্রুপ ভারী করতে ওইসব স্কুলগুলোতেও নিজেদের অনুসারী তৈরি করেছেন চট্টগ্রাম কলেজের নেতারা। চট্টগ্রাম কলেজের মারামারির সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতেও দেখা গেছে অন্য স্কুলের ছাত্রদের।
বড় নেতাদের প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে স্কুলের গণ্ডি পার না হওয়া এসব শিক্ষার্থী। চট্টগ্রাম কলেজ ছাড়াও স্থানীয় যুবলীগের ক্রীড়া সম্পাদক আব্দুর রউফের একটি বলয় আছে এসব স্কুলে। বিভিন্ন সময় বড় নেতাদের সরাসরি নির্দেশে মারামারি, এমনকি অস্ত্র প্রদশর্নের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে স্কুলের ছাত্ররা।
২০১৮ সালে জামালখান আইডিয়াল স্কুলের সামনে রউফের অনুসারীরা ছুরি মেরে হত্যা করে কলেজিয়েট স্কুলের ১০ শ্রেণির ছাত্র আদনানকে। সম্প্রতি সরস্বতী পূজার দিন চট্টগ্রাম কলেজের সামনে যে সংঘর্ষ হয়, তাদের একপক্ষ রউফের অনুসারী।
চট্টগ্রাম কলেজে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক আব্দুল মোতালেব বলেন, ‘রাজনীতি থাকুক বা না থাকুক, তাতে কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে শিক্ষার পরিবেশ কোনোভাবেই নষ্ট করা যাবে না। যেখানে ছাত্রলীগের নেতারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় সহযোগিতা করবে, সেখানে ওরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে পড়ালেখার পরিবেশ শেষ করছে। আমরা এমন ছাত্ররাজনীতি চাই না। এখন মেয়েকে কলেজে পাঠাতে ভয় হয়, আতংকে থাকি; কখন কি হয়ে যায়।’
১৯৮৪ সালে সত্যজিৎ চক্রবর্তী সুজনকে আহ্বায়ক করে এই কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়া হয়। এরপর ১৯৮৬ সালে শিবির নেতাকর্মীরা কলেজে একক আধিপত্য বিস্তার করে। দীর্ঘ তিন দশক পর ২০১৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা শিবিরকে বিতাড়িত করে কলেজে পুনরায় ছাত্রলীগের নিশানা ওড়ায়।
ডিজে