চট্টগ্রাম ওয়াসার সিস্টেম এনালিস্টই চলেন সিস্টেমের বাইরে, বিলের ফাঁদ পেতে হাতিয়ে নেন টাকা

চট্টগ্রাম ওয়াসার সিস্টেম এনালিস্ট শফিকুল বাশার। কিন্তু তিনি নিজেই চলেন সিস্টেমের বাইরে। গ্রাহকের বিল আটকে রেখে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

চট্টগ্রামভিত্তিক একটি ফেসবুক পেইজে ওয়াসার পানি বিল নিয়ে বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। আর সবারই আঙুল ওই শফিকুলের দিকেই। ফেসবুক পেইজে একটি পোস্টে কয়েকজন ব্যক্তি শফিকুলের বিরুদ্ধে টাকা হাতিয়ে নেওয়া কথা জানিয়েছেন।

শফিকুলের স্ত্রী লুৎফি জাহানও কাজ করেন চট্টগ্রাম ওয়াসায়। তিনি হচ্ছেন কম্পিউটার প্রোগ্রামার। এছাড়া তিনি ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) ‘ভাগনি’ হিসেবে পরিচিত। আর এ সুবাদেই নিয়ম নীতি না মেনে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বেড়ান শফিকুলও। কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

ফেসবুকের ওই পোস্টের কমেন্ট বক্সে মো. ওমর ফারুক নামে এক ব্যক্তি লেখেন, ‘আমি ১০ মাস আগে চট্টগ্রাম ওয়াসা থেকে পানির লাইন নিই। কিন্তু এখনো পানির বিল পাইনি। যোগাযোগ করা হলে ওয়াসার সিস্টেম এনালিস্ট শফিকুল বাশার জানান, বিল মাইগ্রেশনে আছে। টাকা ছাড়া কাজ করা যাবে না। চট্টগ্রামের হাজার হাজার মানুষ তার কাছে জিম্মি।’

একই পোস্টে সানজিদা আকতার সিতু লেখেন, ‘দুই বছর পর বিল পাইছি। তাও জুতার তলা ক্ষয় করে পাইছি। বিল এসেছে ১০ হাজার টাকা।’

মো. কবির নামে একজন লেখেন, ‘আমারও এক বছর হয়ে গেছে, আমি ওয়াসার বিল পাইনি।’

ফেসবুকের ওই পোস্টের সূত্র ধরে সরেজমিন অনুসন্ধান এ ঘটনার সত্যতাও মিলেছে। আলমগীর হায়দার নামে বিলের খোঁজ নিতে আসা এক গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি আড়াই বছর পানির বিল পাননি। হঠাৎ গতমাসে তাকে ২৫ হাজার টাকা পানির বিল ধরিয়ে দেয় মিটার রিডার সহকারী বদি আলম।

আলমগীর জানান, তাদের বাসা চান্দগাঁও আবাসিকে। বেশিরভাগ সময় তাদের ডিপ টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করতে হয়। ওয়াসায় কয়েকবার ঘুরেও সময়মতো বিল পাননি তিনি। মিটার রিডার বিভাগ থেকে সিস্টেম এনালিস্ট শফিকুল বাশারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ চান। এরপর রাগ করে বিল না নিয়েই বাসায় ফেরেন তিনি।

জানা যায়, সরকার অনুমোদিত চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালায় মোট পদ রয়েছে ৭৬টি। প্রবিধানমালায় নেই কম্পিউটার প্রোগ্রামার পদ। অথচ এই পদটিতে ২০১২ সালের ৭ নভেম্বর যোগদান করেন লুৎফি জাহান। পদটির জন্য আহ্বান করা বিজ্ঞপ্তিতে তিন বছরের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ ছিল। কাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা না থাকা ও আবেদনে সংযুক্ত কাগজের ফটোকপি সত্যায়িত না থাকার কারণে লুৎফির চাকরির আবেদন বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু বাতিল হওয়া সেই প্রার্থীকে পরবর্তীতে নিয়োগ দেওয়া হয়।

এরপর একইভাবে ওয়াসায় চাকরি পান লুৎফির স্বামী শফিকুল। তার চাকরির জন্য করা আবেদনপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত কাগজের ফটোকপি সত্যায়িত না হওয়ায় আবেদনটি বাতিল হয়ে যায়। আবেদন বাতিল হওয়াতে পরবর্তী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তার অংশ নেওয়ার কথা না থাকলেও তিনি ২০১৬ সালের ৬ জুন চাকরিতে যোগদান করেন। সেইসঙ্গে নিয়োগ পাওয়া লুৎফি ও শফিকুলের স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রত্যায়ন ভুয়া ছিল বলেও জানা গেছে।

চট্টগ্রাম ওয়াসায় স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন অডিট অধিদপ্তর টিমের তদন্তেও স্বামী-স্ত্রীর এই গায়েবি নিয়োগের বিষয়টি উঠে আসে। এ নিয়ে অধিদপ্তরের অডিট অ্যান্ড একাউন্টস অফিসার মো. মোহসীন সোহাগ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ওয়াসার কাছে এ নিয়োগের জবাব চাওয়া হয়।

চট্টগ্রাম ওয়াসায় ৭৮ হাজার গ্রাহক রয়েছে। এরমধ্যে ৭৮ শতাংশ আবাসিক আর ১২ শতাংশ অনাবাসিক গ্রাহক। এসব গ্রাহকদের কেউই ঠিকমত পানির বিল পান না। রাজস্ব শাখায় বিলের খোঁজ করলে মিটার রিডাররা সিস্টেম এনালিস্টের রুমে গিয়ে খোঁজ নিতে বলেন। সেখানে গিয়ে খোঁজ করলেই শফিকুল বাশার নানা অজুহাত দেখান। অনেক সময় প্রিন্টার নষ্ট, প্রোগ্রামার অনুপস্থিত, বিল রেডি হয়ে রাজস্ব শাখা থেকে আসেনি বলে গ্রাহকদের হয়রানি করেন।

কেউ কিছু বলতে গেলেই শফিকুল টেনে আনেন ওয়াসার এমডির রেফারেন্স। গ্রাহককে তিনি বেশি কথা বলতেও নিষেধ করেন। প্রতিদিন অফিস চলাকালীন সময় তার রুমের সামনে গ্রাহকের জটলা লেগেই থাকে। বেশিরভাগ গ্রাহকের মুখে শোনা যায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শফিকুল বাশার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তা ভুয়া ও বানোয়াট।’

ক্ষোভ ঝেড়ে শফিকুল বলেন, ‘যারা বলেন আমি সিস্টেম এনালিস্ট হয়েও সিস্টেমে চলি না, তাদের কথা ভুল। গ্রাহকদের আমার সামনে এসে অভিযোগ করতে বলেন। আমার নামে একটা চক্র দীর্ঘদিন ধরে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। যেটি সামাজিক মাধ্যম পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিন্তু সেগুলো মূল্যহীন।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!