চট্টগ্রাম ওয়াসায় আজগুবি ওভারটাইম, দু ঘন্টার অভিযানে দুদক

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) চট্টগ্রাম ওয়াসা কার্যালয়ে গিয়ে কর্মচারীদের অস্বাভাবিক ওভারটাইম সংক্রান্ত কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে। দুদক জানিয়েছে, তদন্তের অংশ হিসেবে তারা নথিপত্র সংগ্রহ করে।

দুদক জেলা সমন্বিত কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এর সহকারী পরিচালক জাফর আহমেদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল মঙ্গলবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম ওয়াসায় অবস্থান করেন। দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. নূরুল ইসলাম ও কনস্টেবল ফিরোজ এ সময় জাফর আহমদের সঙ্গে ছিলেন।

দুদকের উপ-পরিচালক মো. নূরুল ইসলাম জানান, দুদক টিম চট্টগ্রাম ওয়াসার কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে। এর মধ্যে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসন) গোলাম হোসাইনের সঙ্গেও তারা কথা বলেন এবং ভৌতিক ওভারটাইম সংক্রান্ত কিছু নথিপত্র সংগ্রহ করেছেন।

তিনি বলেন, দুদকের প্রধান কার্যালয় বরাবরে অভিযানের বিষয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করে পরবর্তী তদন্তের জন্য সুপারিশ করা হবে।

চট্টগ্রাম ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসন) গোলাম হোসাইন জানান, ‘তদন্তের জন্য দুদক টিম সকালে এসে প্রায় দুই ঘণ্টা অবস্থান করে। তারা আমাদের কাছ থেকে কিছু কাগজ নিয়ে গেছে।’

দুদকের উপ-পরিচালক লুৎফুল কবির চন্দনও নিশ্চিত করেছেন, একটি এনফোর্সমেন্ট টিম চট্টগ্রাম ওয়াসা পরিদর্শন করেছে।

গত ৩ ও ৪ নভেম্বর দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনে চট্টগ্রাম ওয়াসায় যত বড় বেতন নয় তত বড় ওভারটাইম এবং বন্ধ পাম্প ‘চালাতে’ ২৪ ঘন্টার ২৯ ঘন্টাই কাজ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের বরাত দিয়ে।

২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মীদের বেতনের তালিকা এবং অন্যান্য নথি ঘেঁটে জানা গেছে, ওয়াসার বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতি মাসে ওভারটাইম বাবদ অস্বাভাবিক পরিমাণে টাকা তুলে নিচ্ছেন। নথিগুলোতে অন্যান্য অনিয়মের পাশাপাশি ওয়াসা কর্মীদের ভুতুড়ে ওভারটাইমের অনেক ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। দেখা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাটে চট্টগ্রাম ওয়াসার বুস্টার স্টেশনে কর্মরত ২০ জন কর্মীর মধ্যে ১৭ জনই তাদের বেতনের চেয়ে দ্বিগুণ টাকা ওভারটাইম হিসেবে দেখিয়ে টাকা তুলে নিচ্ছেন বছরের পর বছর। প্রায় একই ধরনের পরিস্থিতি দেখা গেছে চট্টগ্রাম ওয়াসার অন্যান্য স্টেশনেও, যেখানে কর্তৃপক্ষ অস্বাভাবিক ওভারটাইম বিলের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে।

তদন্তে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম ওয়াসার শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার ও মডিউল ১, ২, ও ৩-এ কর্মরত পাম্প অপারেটর, ইলেকট্রিশিয়ান, সহকারী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ল্যাবরেটরি সহকারীসহ মোট ৪৯ স্থায়ী কর্মচারীর সবাই ওভারটাইমের নাম দিয়ে বড় অঙ্কের টাকা তুলেছেন।

নথি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০১৯ সালের জুলাই মাসেই চট্টগ্রাম ওয়াসার ২২৯ জন পাম্প অপারেটর এবং ইলেকট্রিশিয়ান ওভারটাইম হিসেবে পেয়েছেন ৩৪ লাখ টাকা।

প্রতি বছর কর্মচারীদের বেতন বাবদ ৪.১৬ কোটি টাকা এবং ওভারটাইম বাবদ তার চেয়েও বেশি ৫.১৯ কোটি টাকা ব্যয় করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এতে বোঝাই যাচ্ছে, পর্যাপ্ত জনবল থাকার পরও কাগজেকলমে অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা বা ওভারটাইম দেখিয়ে অতিরিক্ত টাকা তুলে নিচ্ছে ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট খাজা রোডের ৪ নম্বর পাম্প স্টেশনে ওয়াহিদুর রহমান, আক্তার হামিদ খান ও গিয়াস উদ্দিন মুর্শেদ নামের তিন কর্মচারী ৩৭৬ ঘন্টা ওভারটাইমের বিল জমা দেন চলতি বছরের জুলাইয়ে। ওই একই মাসে তাদের নিয়মিত কর্মঘন্টা ছিল ৫২৮ ঘন্টা। অস্বাভাবিক এই হিসেব অনুযায়ী প্রতিদিন তারা ২৯ ঘন্টা করে কাজ করেছেন। ৩১ দিন ধরে পুরো জুলাই মাস চিরাচরিত নিয়মে ৭৪৪ ঘন্টায় হলেও ওই মাসে এই তিন কর্মচারী কাজ করেছেন ৯০৪ ঘন্টা। অর্থাৎ ২৪ ঘন্টার বদলে সেখানে দিন গড়িয়েছে ২৯ ঘন্টায়!

এমন পুকুরচুরি শুধু এই তিন কর্মচারীই নয়, চট্টগ্রাম ওয়াসাজুড়ে এমন চিত্র অহরহ।

চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, বাকলিয়া আর খাতুনগঞ্জ নিয়ে গঠিত হয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসার মডিউল ৩। শুরুতে এসব এলাকায় পানি সরবরাহের জন্য ছিল মোট ৩৯টি পাম্প। কিন্তু এর মধ্যে বর্তমানে চালু আছে মাত্র তিনটি পাম্প। বাকি ৩৬টি পাম্প বন্ধ রয়েছে ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে। বন্ধ হয়ে গেলেও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এসব পাম্প থেকে কর্মীদের প্রত্যাহার করেনি। বন্ধ এসব পাম্পেও কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন তো বটেই, এমনকি ওভারটাইমও পেয়ে আসছেন।

দেখা গেছে, ২০১৬-১৭ সালে প্রতি মাসেই ওভারটাইম বাবদ খরচ হয়েছে ৩০.৭৫ লাখ টাকা। আর ২০১৮-১৯ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৪.৬৭ লাখ টাকা।

মুআ/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!