চট্টগ্রামে ৭০০০ অনলাইন উদ্যোক্তা, ২০ হাজারে শুরু করে মাসে আয় লাখ টাকা

করোনার শুরুতেই যখন স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যায়, তখন আরও অনেকের মতোই স্কুলশিক্ষিকা মনীষা বোসের চোখেও নেমে আসে অন্ধকার। আয়ের পথটি তার নিমেষেই বন্ধ হয়ে যায়। ঘরবন্দি এই সময়ে কী করবেন, কিভাবে চলবেন— ভাবতে ভাবতেই মাথায় এলো অন্য চিন্তা। ‘পদ্মালয় বিডি’ নাম দিয়ে ফেসবুকে খুললেন একটি পেইজ— অনলাইনে বিক্রি করবেন মণিপুরী শাড়ি। সেই শাড়ি বিক্রি হবে কি হবে না— এই দ্বিধা নিয়ে শুরু করে দেখতে দেখতেই জমে গেল তার অনলাইন ব্যবসা। কর্মহারা মনীষা আশার আলো খুঁজে পেলেন মেয়েদের পোশাকের অনলাইন ব্যবসাটি থেকেই।

মনীষাই শুধু নয়, চট্টগ্রামে তার মতো আরও অন্তত সাত হাজার অনলাইন উদ্যোক্তার জন্ম হয়েছে করোনা মহামারির ঘরবন্দি সময়টাতে। বিস্ময়করভাবে এদের ৭০ ভাগই নারী— অনেকেই একেবারে সাধারণ গৃহিণী। দুর্যোগের মধ্যে অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে আয়ের বিকল্প উপায় খুঁজে নিয়েছেন তারা। এদের অনেকেই ন্যূনতম ২০ হাজার টাকায় ব্যবসা শুরু করে এখন প্রতি মাসে আয় করছেন লাখ টাকারও বেশি।

ফেসবুকভিত্তিক ডিজিটাল প্লাটফর্ম চট্টগ্রাম ই-কমার্স ফ্যামিলির (সিইএফ) সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ৫৭ হাজার। এর মধ্যে ১০ হাজারেরও বেশি সক্রিয় সদস্য। এর অ্যাডমিন সাগর দে বললেন, ‘মহামারির সময় কাজ হারিয়ে ফেলা প্রায় সাত হাজার উদ্যোক্তা দুর্যোগের ওই সময়টাতে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করেন। উদ্যোক্তা হওয়ার পর তারাই এখন নিজেদের পরিবারে বড় অবদান রেখে চলেছেন।’

তিনি জানান, সিইএফ উদ্যোক্তাদের জন্য বেশ কিছু অনলাইন কর্মসূচির আয়োজন করেছে। গত এপ্রিল মাস থেকে ২২০ জনকে দিয়েছে প্রশিক্ষণও। মানের সঙ্গে আপস না করে পণ্যের দাম কিভাবে সাশ্রয়ী রাখা যায়— প্রশিক্ষণের মূল ফোকাস থাকে সেদিকে। এই ফোকাসটা ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসে ক্রেতাদের আস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। এর ফলও মিলছে হাতেনাতে— চট্টগ্রামের বাজার এখন প্রতিদিনই বাড়ছে।

নতুন ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের কাজটি জটিলও কিছু নয়। সাধারণত তারা পণ্যের ছবি ও বিবরণ তাদের ফেসবুক পেইজ কিংবা একাউন্টে তুলে ধরেন। এর পাশাপাশি ফেসবুকভিত্তিক ই-কমার্স গ্রুপগুলোতেও ওইসব পণ্যের সারাংশ দিয়ে থাকেন। ক্রেতারা সেখান থেকে পণ্য বেছে নিয়ে অর্ডার করেন। সেই পণ্য এরপর ডেলিভারি পার্সন বা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে পাঠানো হয়। আবার পণ্য হাতে পাওয়ার পর গ্রাহকরা বিভিন্ন ই-কমার্স গ্রুপে সেগুলোর রিভিউ লিখেন। এই রিভিউ আবার উদ্যোক্তাদের প্রচার পেতে বেশ কাজে দেয়।

স্কুলশিক্ষিকা মনীষা অল্প কিছু মূলধন নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পেরেছিলেন শুধু অনলাইনের ভরসায়। তিনি বললেন, ‘ট্রাডিশনাল বিভিন্ন পণ্যকে প্রমোট করার আগ্রহ ছিল আমার। এ কারণে সিলেটের মণিপুরী শাড়ি নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে একবিন্দু ভাবতে হয়নি। অবশ্য ব্যবসা চালুর শুরুতেই ঈদুল ফিতরকেন্দ্রিক বাজার পাওয়াটা ছিল আমার জন্য টার্নিং পয়েন্ট।’

চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের শিক্ষক থেকে অনলাইন উদ্যোক্তায় রূপ নেওয়া ফারজানা আক্তার বললেন, ‘গত জুন মাসে মাত্র ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে আমি ই-কমার্স ব্যবসায় পা রাখি। মাত্র তিন মাসের মধ্যে আমার সেই মূলধন হয়ে গেছে চারগুণ। ডিজিটাল মার্কেটিং, বিশেষ করে ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপ আমার ব্যবসার উন্নয়নে খুব সাহায্য করেছে।’

ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসের অবস্থা এখন এমন যে, গয়না থেকে শুরু করে বাড়িতে তৈরি খাবার— সবকিছুই এখন উদ্যোক্তাদের কাছে মিলছে। কেনাকাটার ঝামেলা এড়িয়ে সময় বাঁচিয়ে ক্রেতারা ক্রমেই ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি।

জামিল আল ফয়সালের ব্র্যান্ড ‘নিমরাহ’ অনলাইন মার্কেটপ্লেসে অর্গানিক খাবার বিক্রি করে। জামিল ও তার বন্ধুরা মিলে গত জুলাই মাসে ২ লাখ টাকা দিয়ে ব্যবসাটি শুরু করেন। ই-কমার্স গ্রুপ থেকে তারা ব্যবসার উন্নয়নে বেশ সহযোগিতা পান। জামিল বললেন, ‘সারা দেশেই এখন আমাদের গ্রাহক আছে। লাভও বাড়ছে। আমি ও আমার বন্ধুরা এখন এই ব্যবসার ওপর ভর করেই স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন দেখছি।’

জামিল দেখেছেন, ফেসবুকভিত্তিক ই-কমার্স গ্রুপগুলো নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে দারুণ ভূমিকা রাখছে। করোনার কারণে কর্মহীন অনেক উদ্যোক্তা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের সাথে সংযুক্ত হওয়ার পর প্রতি মাসে ১ লাখ টাকার বেশি আয় করছেন।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘প্রতি ১০ বছরে ব্যবসার ধরন বদলে যায়। ই-কমার্স এমন এক সময়ে নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগ হিসেবে উঠে এলো, যখন কিনা অন্য প্রচলিত ধারার ব্যবসাগুলো রীতিমতো বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে।’

চট্টগ্রাম উইম্যান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মনোয়ারা হাকিম আলীর মুখেও মাহবুবুল আলমের কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল। তিনি বললেন, ‘চেম্বারের অনেক সদস্য ইতোমধ্যে ই-কমার্সের সাথে জড়িত। মহামারির সময় নতুন উদ্যোক্তারা শুরু করেছেন ডিজিটাল স্টার্টআপ। সবমিলিয়ে এটি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’

কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘সময়ের প্রয়োজনেই ডিজিটাল বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। তবে ই-কমার্সের জন্য কোনো নীতিমালা না থাকায় এখনও একটি ঝুঁকি আছে যে ভোক্তারা প্রতারিত হতে পারেন। উদ্যোক্তা ও ক্রেতা উভয়ই উপকৃত হবে— যদি একটি সরকারি নীতি অনলাইন মার্কেটপ্লেসকে পথ দেখায়।’

সিপি

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড অবলম্বনে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!