চট্টগ্রামে ১০৫ শিশু নিরবে সয়ে যাচ্ছে করোনার বিষ

মাসই পূর্ণ হয়নি এখনও। গুণে গুণে এখন মাত্র পনেরো দিনের নবজাতক। এর আগে চট্টগ্রামে তিন মাস, আট মাস ও দশ মাস বয়সী শিশুর শরীরে করোনার জীবাণু পাওয়া গেছে। তবে জন্মের পরপরই একদিন বয়সে এ নবজাতক দেশের সবচেয়ে কম বয়সী করোনা পজিটিভ রোগী হিসেবে নাম লিখিয়েছে। করোনা আক্রান্ত মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া ছোট্ট তুলতুলে নরম শরীরটি নিরবে সয়েছে করোনার বিষ। হাসপাতালের বিছানায় মায়ের কোলই ছিল তার পুরো পৃথিবী। করোনার কোপে হাসপাতালের চার দেয়ালের মাঝে লড়াই করেছে টানা ১০ দিন। করোনা যুদ্ধে শেষমেষ দশ দিনের লড়াইয়ে রেহাই মিলেছে এ নবজাতকের। মায়ের সাথে সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরেছে।

এদিকে চট্টগ্রামে দেখা গেছে, বড়দের সঙ্গে সঙ্গে শিশুরাও সংক্রমিত হচ্ছে করোনায়। যা চট্টগ্রামে শনাক্ত হওয়া করোনা আক্রান্ত রোগীর শতকরা দুই ভাগ। এ পর্যন্ত করোনার শিকার হয়েছে চট্টগ্রামের শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সী ১০৫ জন শিশু। এ শিশুদের মধ্যে ৬৯ জন ছেলে এবং ৩৬ জন মেয়ে। এর মধ্যেই করোনায় নিভে গেছে পটিয়া উপজেলার ছয় বছর বয়সী একজনের জীবনপ্রদীপ। উল্টো দৃশ্যও আছে। জীবনের সাথে লড়াই করে করোনাকে হারিয়ে বীরবেশে বাড়ি ফিরেছে চন্দনাইশের ১০ মাস বয়সী এক শিশু।

তবে অবাক করা বিষয় হল, এতোগুলো শিশু করোনায় আক্রান্ত হলেও করোনাভাইরাসের বিশেষায়িত চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মাত্র তিনজন। এর মধ্যে করোনার সাথে লড়ে হেরে গেছে ৬ বছরের এক শিশু, ১০ মাসের আরেক শিশু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে এবং সর্বশেষ চারদিন বয়সে শনাক্ত হওয়া পনেরো দিনের শিশুটিও জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। এর বাইরে বাকি শিশুরা হোম কোয়ারেন্টাইনেই রয়েছে।

সাধারণত করোনা আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে যে কেউ করোনায় আক্রান্ত হয় বা হতে পারে। তেমনিভাবে জন্মের পরপরই একদিন বয়সে করোনায় আক্রান্ত মায়ের কাছ থেকে করোনায় সংক্রমিত হয়েছে পনেরো দিনের এ শিশু। অন্যদিকে এর বিপরীত ঘটনাও আছে।

চন্দনাইশের ১০ মাস বয়সী এক শিশু গত ২১ এপ্রিল করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়। ঝুঁকি জেনেও মাতৃত্বের টানে জেনারেল হাসপাতাল ওই শিশুকে ছেড়ে যাননি তার মমতাময়ী মা। চিকিৎসকরা মোটামুটি নিশ্চিতই ছিলেন, ওই মাও সবসময় শিশুর সংস্পর্শে থাকায় তিনিও করোনায় আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন। বারকয়েক নমুনাও পাঠানো হয়েছিল ল্যাবে। কিন্তু না, প্রতিবারই অদ্ভূত কোনো কারণে এই মা করোনায় সংক্রমিত হননি। করোনার সঙ্গে লড়ে দুধের শিশুটাকে নিয়েই হাসপাতাল ছেড়েছেন তিনি।

আবার পটিয়ার ছয় বছর বয়সী এক প্রতিবন্ধী শিশুর করোনা পজিটিভ এলে আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তির আধ ঘন্টার মধ্যেই ওই শিশু মারা যায়। তবে করোনা পজিটিভ হওয়ার পর অ্যাম্বুলেন্সে ছেলের সাথে হাসপাতাল আসা, আবার মৃত শিশুকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া, গোসল করানো সবই করেছেন মা। বাবা স্বয়ং নিজের কোলে করে ছেলে অন্তিম শয্যায় শায়িত করেন। কিন্তু তাদের দুজনের কেউই করোনায় সংক্রমিত হননি।

যেভাবে করোনায় আক্রান্ত হয় শিশুরা
করোনার কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের প্রধান শিকার শিশুরা। করোনার যেকোনো বাহকের সংস্পর্শে কিংবা তার সর্দি, হাঁচি, কাশির মাধ্যমে একে-অন্যের শরীরে ছড়াতে পারে করোনাভাইরাস। আক্রান্ত শিশুর পরিবারের যেকোনো সদস্যের সংস্পর্শেও হতে পারে। সর্বশেষ চট্টগ্রামে শনাক্ত হওয়া চারদিন বয়সী শিশু মাতৃগর্ভে থেকেই করোনা আক্রান্ত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন চিকিৎসকরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের আসল বাহক কে— তা সহজে শনাক্ত করতে না পারায় যেকোনো বাহকের সংস্পর্শেই শিশুরা সহজে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে যেকোনো বয়সের শিশুর করোনা হতে পারে। সেক্ষেত্রে পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক ও শারিরীক দূরত্ব নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

করোনা আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা হচ্ছে যেভাবে
করোনার সুনির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা না থাকলেও আপাতত দৃষ্টিতে বড়দের উপসর্গের ধরন দেখে ট্যাবলেট কিংবা ক্যাপসুল দিয়ে চলছে করোনা রোগীর চিকিৎসাসেবা। কিন্তু পনেরো দিন বয়সী শিশুটিকে সে চিকিৎসা দেয়ারও কোন উপায় ছিল না। তাহলে কিভাবে চলেছে এই দুধের শিশুর চিকিৎসা?

এই প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আব্দুর রব মাসুম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাচ্চাটিকে তো ট্যাবলেট দেওয়ার সুযোগ নেই। স্বাভাবিকভাবেই এত ছোট বাচ্চাকে বড়দের মতো কোনো চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ নাই। তবে শিশুদের জ্বর বা কাশির জন্য যে ওষুধপত্র দেওয়া হয় এ শিশুর ক্ষেত্রেও তাই দেয়া হয়েছিল। আর শিশুটির মাও করোনায় আক্রান্ত ছিল। দুজনই একসাথে গাইনী বিভাগে আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাদের বাকি রোগীদের কাছ থেকে আলাদা রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। ’

ডা. আব্দুর রব আরও বলেন, ‘করোনা শনাক্ত হওয়ার পর যেসব বাচ্চার শারীরিক অবস্থা জটিল হয়েছে, তারাই জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে এসেছে। শনাক্ত হওয়া এসব শিশুর অধিকাংশই বাড়িতে হোম কোয়ারেন্টাইনে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিচ্ছে। এরমধ্যে চন্দনাইশের ১০ মাসের শিশু চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পটিয়ার শিশুটি হাসপাতালে ভর্তির আধঘন্টার মধ্যেই মারা যায়। তবে মায়ের সাথে করোনা শনাক্ত হওয়া পনেরো দিনের নবজাতকটি ১০ দিনের লড়াই শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। জেনারেল হাসপাতালে এখন কোনো শিশু রোগী নেই। করোনা পজিটিভ বাকি শিশুরা চিকিৎসকের পরামর্শে হোম কোয়ারেন্টাইনে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!