চট্টগ্রামে হিন্দু নারীর শেষকৃত্য হল ‘হুজুরদের’ কাঁধে চড়ে, কাছে আসেনি স্বজনরা

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম এই জিজ্ঞাসে কোন জন হে, কাণ্ডারি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র’— সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুলের কবিতার এই দুটো লাইন যেন ঘুরে ফিরে আবারও সামনে আসছে করোনাকালে। আত্মীয়স্বজন, জাতপাতের প্রচলিত ধারা ভেঙ্গে বিপদে শুধুমাত্র মানুষ পরিচয়ে মানবিকভাবে পাশে দাঁড়ানোর শত গল্প গত বছর জুড়ে দেখছে বাংলাদেশ। যার তালিকায় নতুন এক মাত্রা দিল চট্টগ্রামের টিম আল মানাহিল।

এক হিন্দু নারীর দাহ প্রক্রিয়ায় আল মানাহিলের সদস্যদের আন্তরিক ভূমিকার কথা তুলে ধরে ওই নারীর ভাইপো নিরুপম দাশের দেওয়া একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস যেন আবারও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে নজরুলের কবিতার ওই দুই লাইনকে। নিরুপম দাশ পেশায় একজন চিকিৎসক। তিনি চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের (বিডিএফ) প্রধান প্রশাসকও।

চট্টগ্রামে হিন্দু নারীর শেষকৃত্য হল ‘হুজুরদের’ কাঁধে চড়ে, কাছে আসেনি স্বজনরা 1

শুক্রবার (৭ মে) নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে দেয়া ওই পোস্টে নিরুপম দাশ নিজের অনুভূতি তুলে ধরেছেন ঠিক এইভাবে— ‘গতকাল আমার মাকে (পিসিকে তিনি মা সম্বোধন করেছেন) গোসল করাইছে, কাপড় পরাইছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জামে মসজিদের পাশের একটা রুমে খালারা। লাশ বহন করেছে, পুরো দাহ করার সময় উপস্থিত ছিলেন দুই জন হুজুর। সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে ৩ টা পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন তারা। যেখানে আমাদের আত্মীয়-স্বজন ছিলেন না, সেখানে তারা দুইজন অন্য ধর্মের হয়েও সাথে ছিলেন। আমার সহকারীসহ। আল মানাহিল ফাউন্ডেশনের প্রতি কৃতজ্ঞতা।’

অল্প সময়ের মধ্যেই ফেসবুকে ভাইরাল হয় সেই পোস্ট। যদিও আল মানাহিলের এমন কাজ এবারই প্রথম নয়। পরিবারের কাউকে ছাড়াই এমন অনেক লাশ তারা করোনাকালে দাফন করেছেন। লাশের পরিচয় বা ধর্ম জানলে তারা সেই অনুযায়ী দাফন করেছেন এমন উদাহরণও চট্টগ্রামে দেখিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আল মানাহিল।

স্বজন ছাড়াই অন্য ধর্মের লাশের শেষকৃত্যে অংশ নিয়েছেন সংগঠনের সদস্য আসাদুল্লাহ, ইসমাইল ও আবদুল্লাহ। তারা তিনজনই মাদ্রাসায় পড়ালেখা করছেন। মাদ্রাসা বন্ধ থাকায় এখন আল মানাহিল টিমের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন তারা।

চট্টগ্রামে হিন্দু নারীর শেষকৃত্য হল ‘হুজুরদের’ কাঁধে চড়ে, কাছে আসেনি স্বজনরা 2

এ প্রসঙ্গে আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের অন্যতম পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘করোনার শুরু থেকেই আমরা এই কাজ করে চলেছি। এই পর্যন্ত আমরা প্রায় দুই হাজারেরও বেশি লাশ দাফন ও সৎকার করেছি। এর মধ্যে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একশ জনেরও বেশি মানুষ ছিলেন। এই দুর্যোগে মানুষই তো মানুষের পাশে দাঁড়াবে।’

তিনি বলেন, ‘তাদের মা একদিন টিভিতে দেখেন বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় করোনায় মৃতদের লাশ ফেলে চলে যাচ্ছে। সেটা দেখে তিনি আমাদের (মহিলার অন্য সন্তানদেরসহ) বলেছিলেন চট্টগ্রামে যদি এমন পরিস্থিতি হয় তাহলে তোমরা গিয়ে দাফন করবা। আল্লাহ কপালে যা রাখছে তা হবে। ভয় পাবা না।’

এরপর থেকেই তারা চট্টগ্রামে লাশ দাফন ছাড়াও হাসপাতাল নির্মাণ করে ফ্রি চিকিৎসা, ইফতার সাহরি দেওয়াসহ বিভিন্ন মানবিক কাজে যুক্ত আছেন।

মৃত সেই নারীর ভাইয়ের ছেলে নিরুপম দাশ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘উনি পিসি হলেও তিনি আমাদের মায়ের মতো। তার নিজের সন্তানও নেই। তিনি বৃহস্পতিবার বিকালে মা ও শিশু হাসপাতালে করোনা বিভাগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এরপর থেকে লাশ সৎকার পর্যন্ত কিছু হুজুর আমাদের সাথে ছিলেন। আমাদের পিসিমাকে রাত সাড়ে তিনটায় বোয়ালখালীর উত্তর ভূষিতে আমাদের বাড়িতে সৎকার করেছি। এমন পরিস্থিতিতে আল মানাহিলের সদস্যরা যেভাবে এগিয়ে এসেছেন সেটি আমরা চিরজীবন মনে রাখবো।’

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!