চট্টগ্রামে স্বীকৃত মদ্যপায়ী সাড়ে ৫ হাজার, বেনামা তার ১০ গুণ!

চট্টগ্রাম নগরীতে পারমিটধারী মদ্যপায়ীর জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লাইসেন্সপ্রাপ্ত মদের মহাল ও বার আছে প্রায় ২০টি। এর মধ্যে বাংলা মদের মহাল আছে চারটি। আর বিভিন্ন তারকা হোটেল ও বারের সংখ্যা আরও ১৬টি। কিন্তু সাড়ে পাঁচ হাজার মদ্যপায়ী পারমিটভুক্ত হলেও এই নগরীতে মদ্যপায়ীর সংখ্যা তার থেকে বহুগুণ বেশি। বিভিন্ন সূত্র ও মাধ্যমের হিসেবে এ সংখ্যা অন্তত ১০ গুণ।

বেশিরভাগ মদ্যপায়ীই এসব বৈধ মদের মহাল ও বারে এসে মদ পান করেন অবৈধভাবে। বেশি বিক্রিতে বেশি লাভ। এই কারণে পারমিট না দেখেই গণহারে মদ বিক্রি করছে নগরীর ২০টি বার ও মহাল মালিকরা। বিশেষ করে মদের মহালগুলোকে কেন্দ্র করে বেআইনি চোলাই মদের ব্যবসা ছেয়ে গেছে নগরজুড়ে।

নামমাত্র লাইসেন্স আর মদ পানের পারমিটকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এসব নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে প্রকাশ্যেই দিনরাত সমানতালে মদ বিক্রি ও পান করা হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মদের পারমিটধারী মদ্যপায়ীর সংখ্যার চেয়ে কমপক্ষে তিনগুণ বেশি পারমিটবিহীন মদ্যপায়ী অনুমোদিত বার ও মদের মহালে যান। বিশেষ করে নগরীর অনুমোদিত চারটি বাংলা মদের মহালে পারমিটধারী মদ্যপায়ী হাতেগোণা কয়েকজন গেলেও বিভিন্ন তারকা হোটেলে শতকরা ৯৮ ভাগই মদ্যপায়ী পারমিটবিহীন। সেখানে গেলে বারের লোকজন জানতেও চান না মদ পানের পারমিট আছে কিনা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়সারা ভাবের কারণে মদের অবৈধ বাজার দিনে দিনে ফুলেফেঁপে উঠছে।

মাঝে মধ্যে বিভিন্ন মদের মহালে অভিযান চালানো হলেও হোটেল ও বারে অভিযান হয় কদাচিৎ। আর সেই সুযোগেই বিত্তশালীরা বিদেশি মদ পানের জন্য এসব হোটেলে ভিড় জমান। ফলে অবৈধভাবে কারা এসব বার থেকে মদ পান করেন তাও আড়ালে থাকছে। মাঝে মধ্যে অনুমোদিত চারটি মদের মহালে র‌্যাব কিংবা পুলিশ অভিযান চালালে সেখানেও দেখা যায় অপারমিটধারীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। তবে বেশিরভাগই নিম্নআয়ের মানুষ এসব মদের মহালে যান।

সম্প্রতি নগরীর কোতোয়ালী থানার ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় অনুমোদিত অনুপ বিশ্বাসের মদের মহালে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় র‌্যাব অভিযান চালায়। এ সময় বেশিরভাগ মদ্যপায়ী পালিয়ে গেলেও ৪০ জন মদ্যপায়ীকে আটক করা হয়। এর মধ্যে ২৯ জনের কোনও পারমিট ছিল না মদ পানের। এই ২৯ জন মদ্যপায়ীকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে চারদিনের জেল ও ৪০০ টাকা জরিমানার সাজা দেওয়া হয়েছে। ছেড়ে দেওয়া ১৬ জনের মধ্যে পাঁচজন ছিল পথচারী। আর বাকি ১১ জনের অনুমতি ছিল মাদক সেবনের। মাদক সেবনের অনুমতি নেই এমন ২৯ মদ্যপায়ীকে চার দিনের জেল ও ৪০০ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর অঞ্চলের উপ পরিচালক শামীম আহমেদ জানান, চট্টগ্রাম মহানগরীতে অনুমোদিত চারটি বাংলা মদ তথা দেশীয় মদের মহাল রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে চান্দগাঁও থানার কাপ্তাই রাস্তার মাথায় এলাকায় সাধন কুমার বিশ্বাসের নামে একটি, কোতোয়ালী থানার ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় অনুপ বিশ্বাসের নামে একটি ও একই থানার কদমতলী রেলওয়ে ম্যানস ক্লাবে তপন চক্রবর্তীর নামে একটি মদের মহাল রয়েছে।

এছাড়া ইপিজেড থানার মাইলের মাথায় রতন চক্রবর্ত্তীর নামে একটি মদের মহাল রয়েছে। এসবের বাইরে দুই থেকে পাঁচ বা তার চেয়ে বেশি তারকাযুক্ত হোটেল, পর্যটন বা কূটনৈতিক এলাকা, রেস্টুরেন্ট ও ক্লাবে অন্তত ১৬টির মত মদ বিক্রির লাইসেন্স দেওয়া আছে। তবে বাংলা মদের মহালের অনুমতি প্রদান বন্ধ রয়েছে ১৯৯০ সাল থেকে। এখন শুধুমাত্র বিদেশি মদের জন্য বার ও রেস্টুরেন্টে নীতিমালার মানার শর্তে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা আরও জানান, মদ পানের জন্য চট্টগ্রাম নগরীতে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার জনের পারমিট রয়েছে। সেক্ষেত্রে মুসলমান হলে কোনো মুসলমান চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়া মদ বা মদজাতীয় পানীয় পান করতে পারবেন না। চিকিৎসকের সনদ নির্ধারিত ফরমে যুক্ত করে তাঁকে আবেদন করতে হবে। অমুসলিম নাগরিকেরা কোনো নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বেন না। তা ছাড়া মুচি, মেথর, ডোম, ঝাড়ুদার ও চা–বাগানের শ্রমিক ‘পারমিট’ নিয়ে দেশি মদ কিনতে পারবেন। ২১ বছরের নিচে কোনো ব্যক্তির কাছে মদ বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

অন্যদিকে বিদেশি মদ পানের পারমিট পাবার জন্য অমুসলিমদের জন্য বাৎসরিক পারমিট ফি দিতে হয় দুই হাজার টাকা সেই সঙ্গে ৩০০ টাকার ভ্যাট। আর ডাক্তারের সার্টিফিকেটসহ মুসিলমরা যদি পারমিটের জন্য আবেদন করেন তার ক্ষেত্রেও একই হারে ফি ও ভ্যাট দিতে হবে। আবার বাংলা বা দেশীয় মদের পারমিট প্রাপ্তির জন্য অমুসলিম ও মুসলিমের জন্য একই নিয়ম। তবে এক্ষেত্রে বাৎসরিক ফি মাত্র ৮০ টাকা ও ১২ টাকা ভ্যাট দিতে হবে।

অন্যদিকে বিদেশি মদ আমদানি নীতিমালা মেনে নির্ধারিত শুল্ক দিয়ে দুই থেকে পাঁচ বা তার চেয়ে বেশি তারকাযুক্ত হোটেল, পর্যটন বা কূটনৈতিক এলাকা, রেস্টুরেন্ট, ক্লাবে মদ আমদানির সুযোগ রয়েছে। আর অনুমোদিত চার মদের মহালে তাদের চাহিদা অনুযায়ী মদ সরবরাহ করা হয়ে থাকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে।

একটি মহালে কমপক্ষে ২০০ লিটার আর সর্বোচ্চ ৪০০ গ্যালন মদ সরবরাহ করা হয়। এক গ্যালনে মদ থাকে সাড়ে চার লিটার করে। সে হিসেবে ১৮০০ লিটার মদ সরবরাহ করা হয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে। এসব মদ ঈশ্বরদীতে দেশের একমাত্র বাংলা মদ উৎপাদনকারী কারখানা থেকে আনা হয়। তবে এসব মদ মহালে নিয়ে পানি মিশিয়ে ভেজাল করার অভিযোগও রয়েছে মদের মহালের মালিকদের বিরুদ্ধে। আবার অনেকে বিদেশ থেকে আমদানি না করেও চট্টগ্রামেই ভেজাল মদ তৈরি করে বিক্রি করছেন। সেই মদ পান করে সম্প্রতি আকবর শাহ এলাকায় তিন যুবকের মৃত্যুর পর বিষয়টি আলোচনায় আসে। এরপর পুলিশ ওই চক্রের পাঁচ জনকে গ্রেপ্তারও করেছিল।

পরের পর্বে
মদের মহাল নিয়ন্ত্রণের দায় নিতে চায় না পুলিশ ও অধিদপ্তর

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!