চট্টগ্রামে সুবিধাবঞ্চিতদের স্কুল বন্ধ করে গ্যারেজ দিলেন আওয়ামী লীগ নেতা

একসময় ছিলেন ট্রাকের শ্রমিক। সময়ের বিবর্তনে তিনি এখন চড়েন দামি প্রাইভেট কারে। বায়েজিদ থানা এলাকায় চলে তার একক আধিপত্য। তার আধিপত্য এতই বেশি যে, ক্ষমতার জোর দেখিয়ে বন্ধ করে দিলেন সুবিধাবঞ্চিতদের স্কুল। সেই স্কুলকে বানালেন অবৈধ ব্যাটারি রিকশার গ্যারেজ।

বিশাল ক্ষমতাবান সেই লোকের নাম আব্দুল নবী লেদু। একসময় শ্রমিক রাজনীতি করে টাকা কামালেও বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগ নেতা। বায়েজিদ থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি।

বায়েজিদ থানার রৌফাবাদ এলাকায় মুক্তিপাঠশালা নামের স্কুলটিতে স্থানীয় সুবিধাবঞ্চিত ১৫০ শিক্ষার্থীকে দেওয়া হতো প্রাথমিক শিক্ষা। নার্সারি থেকে চতুর্থ শ্রেণির ১৫৩ জন শিক্ষার্থী নিয়মিত পড়তো পাঠশালায়। শিক্ষার্থীদের কেউ বাসা বাড়িতে কাজ করে, আবার কেউ ময়লা কুড়িয়ে সংসারে টাকার জোগান দেয়। কাজের ফাঁকে বিনামূল্যে মুক্তির পাঠশালায় যায় এসব পথশিশুরা।
চট্টগ্রামে সুবিধাবঞ্চিতদের স্কুল বন্ধ করে গ্যারেজ দিলেন আওয়ামী লীগ নেতা 1
কিন্তু সেই মানবিক মুক্তি পাঠশালার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে তাতে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা লেদু। স্কুলের পরিবর্তে তিনি ভাড়া দিয়েছেন ব্যাটারি রিকশার গ্যারেজ। ভুক্তোভোগীদের দাবি, গ্যারেজ প্রায় দেড় লাখ টাকা অগ্রিম জমার শর্তে ভাড়া দেন লেদু। টাকার লোভেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে স্কুলটিও। যদিও জায়গাটির মালিক বা কেয়ারটেকার কোনোটাই নন লেদু। শুধুমাত্র ক্ষমতার দাপটে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি।

স্কুল বন্ধের বিষয়ে জানতে কথা হয় মুক্তি পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা মুক্তি শেখের সঙ্গে। তিনি জানান, ২০২০ সালে বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য জায়গাটিতে নিজের অর্থায়নে একটি কাঁচাঘর তৈরি করেন মুক্তি। এজন্য লেদুর সঙ্গে মৌখিক চুক্তিও হয়।

চুক্তির বিষয়ে মুক্তি জানান, লেদু মামাকে যখন আমাদের এই কার্যক্রমের কথা জানাই, তখন তিনি বলেন—এটা ভালো কাজ, তাই যতদিন ইচ্ছে তোমরা জায়গাটিতে স্কুল চালাতে পারো। সেই হিসেবে গত তিনবছর সুন্দরভাবেই চলছিল স্কুল।

তিনি আরও জানান, কথা রাখেননি লেদু মামা। সপ্তাহখানেক আগে এসে আমাকে লেদু মামা বলেন, স্কুল ছেড়ে দিতে হবে, এর দু’দিন পর এসে আমাদের স্কুলে তালা মেরে দিয়েছেন। ক’দিন বাদেই আমার ছাত্রদের পরীক্ষা। এখন তাদের জীবন অন্ধকারে নিমজ্জিত।

জানা গেছে, স্থানীয় গরিব ও ছিন্নমূলের শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পড়ালেখার ব্যবস্থা করা হয় এই স্কুলে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও সেলাই, বিউটি পার্লারের মত ব্যবহারিক বিষয়েও মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো স্কুলটিতে। তিনজন শিক্ষকের মাধ্যমে নার্সারি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার সুযোগ ছিল মুক্তি পাঠশালাতে।

শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া একটি ঘরের ভাড়ার টাকায় স্কুলটি চালান মুক্তি শেখ। এছাড়াও স্বামীর টাকায় স্কুলটি বানানো হয়েছিলো বলেও জানান তিনি।

স্কুলটি খুলে দেওয়ার জন্য একাধিকবার লেদুকে অনুরোধ করা হলেও তিনি তা মানছেন বলে জানান মুক্তি। এমনকি রৌফাবাদ এলাকায় আসলে মুক্তিকে মারার হুমকিও দিয়েছেন লেদু।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে আব্দুল নবী লেদুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘স্কুল বন্ধ করেছিতো আপনার কি? আপনার কি কাজ?’

স্কুলটি কেন বন্ধ করা হয়েছে—জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এরপর উত্তেজিত হয়ে সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।

এদিকে স্কুলটি তিন মাসের জন্য খোলার অনুমতি দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তিন মাসের জায়গায় তিনবছর চলছিল। এমনকি ওই স্কুলে বহিরাগত যুবকদের নিয়ে অবৈধ কাজ করা হতো বলেও অভিযোগ করেন লেদু।

লেদুর এমন অভিযোগ মিথ্যাদাবি করেন মুক্তি। তিনি বলেন, ‘লেদু স্কুলটি বন্ধ করে দেওয়ার জন্যই এসব মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, লেদু মামা আমার স্কুলে গ্যারেজ বানাচ্ছেন। তাদের থেকে দেড় লাখ টাকা করে নিচ্ছেন, টাকার লোভে তিনি এসব করছেন।’

জায়গার প্রকৃত মালিক কে—জানতে চাইলে মুক্তি বলেন, ‘জায়গার মালিকানা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। কেউ বলে এটি খাস জমি, আবার কেউ বলে মালিকানা জায়গা।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘বড়লোকদের জন্যতো অনেক স্কুল আছে, কিন্তু গরিবদেরতো কেউ নেই, কিছু নেই। স্কুলটিতে গরিব বাচ্চারা পড়তো। গত দু-তিনদিন ধরে দেখছি তালামারা। লেদু সাহেব এই কাজটা না করলেও পারতেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘বহু মামলার আসামি লেদুর ক্ষমতার জোর কোথায় তা আমরা সাধারণ মানুষরা জানি না।’

বিএস/ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!