চট্টগ্রামে সিরাজউদ্দৌলার ‘বংশধর’ পুরোটাই ভুয়া, বলছে জাদুঘরের যাচাই কমিটি

চট্টগ্রামের রাউজানে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধর ও পৌনে ৩০০ বছর আগেকার কথিত প্রমাণপত্রকে ‘ভুয়া’ বলে দাবি করেছেন জাতীয় জাদুঘরের কর্মকর্তারা। চলতি বছরের মার্চে জাদুঘর কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল রাউজানে গিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র পরীক্ষা করে সেগুলো ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে নবাবের বংশধর দাবি করা সেই মাহাদী দাবি করেছেন, ‘যদি জিনিসগুলো আসল না হয় তবে আসলো কোত্থেকে? আমার কাছে কি বানানোর মেশিন আছে?’

চট্টগ্রামের রাউজানে গিয়ে জাতীয় জাদুঘরের যাচাই-বাছাই কমিটি পরীক্ষা করে দেখছেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার কথিত নথিপত্র।
চট্টগ্রামের রাউজানে গিয়ে জাতীয় জাদুঘরের যাচাই-বাছাই কমিটি পরীক্ষা করে দেখছেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার কথিত নথিপত্র।

১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা বাংলার মসনদে বসেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের পরাজয় এবং ২ জুলাই ঘাতকের হাতে তার প্রাণ হারানোর মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে যায় বহুকালের জন্য।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামের রাউজানের এক ব্যক্তি নিজেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধর হিসেবে দাবি করেন। প্রমাণ হিসেবে তিনি সিরাজউদ্দৌলার ব্যবহৃত ছুরি, কাপড়, এমনকি মাথার মুকুটও প্রদর্শন করেন। বাংলার শেষ নবাবের বংশধর দাবি করা নবাব সৈয়দ মাহাদী মতুর্জা আলীউদ্দৌলা খাঁ পরিচয় দেওয়া ওই ব্যক্তি থাকেন রাউজান পৌরসভার ৭নং ওর্য়াডের শাহনগর গ্রামের রাজু কলোনিতে। মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকার ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি।

কিন্তু এত ‘প্রমাণের’ পরও সেই মাহাদীকে ভুয়া ও তার সকল প্রমাণকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করেছেন খোদ জাতীয় জাদুঘরের কর্মকর্তারা। নবাব সিরাজের ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিজ চোখে পরখ করে দেখতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে মাহাদীর বাড়িতে যান বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ডেপুটি কিপার ইলিয়াস খান। তিনি সেই সময় সবগুলো জিনিসপত্র দেখে পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞদের এনে পরীক্ষা করার কথাও দিয়ে আসেন।

পরবর্তীতে জাতীয় জাদুঘরের ডেপুটি কিপার ইলিয়াস খানকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রাথমিক যাচাই-বাছাই কমিটি করা হয়। এই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন জাতীয় জাদুঘরের সংরক্ষণ রসায়নের কিপার আসানুজ্জামান নূরী এবং ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা বিভাগের উপ-কিপার মনিরুল হক। চলতি বছরের মার্চে ইলিয়াস খানের নেতৃত্বে একটি দল গিয়ে নবাব সিরাজের ব্যবহৃত দাবি করা জিনিসপত্রগুলোকে দেখে এগুলোকে ‘ভুয়া’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এমনকি মাহাদী সিরাজউদ্দৌলার ‘বংশধর নন বলেও মন্তব্য করেন।

নবাবের কথিত বংশধর কে এই মাহাদী?

রাউজানের মাহাদীর দাবিমতে, তার পুরো নাম নবাব সৈয়দ মাহাদী মতুর্জা আলীউদ্দৌলা খাঁ। আর দাদার নাম নবাব সৈয়দ মো. শওকত হোসেন আনোয়ার আক্তার চাঁনগাজী। মাহাদীর পৈতৃক নিবাস নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জে হলেও ৪০ বছর ধরে রাউজানের স্থানীয় একটি মসজিদে ইমামতি ও মাদ্রাসার শিক্ষকতার সুবাদে রাউজানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।

তার দাবি, নবাব সিরাজউদ্দৌলার ব্যবহৃত এসব জিনিসপত্র ও নথি তিনি বংশ পরম্পরায় পেয়েছেন।

তিনি বলেন, নবাব সিরাজকে হত্যার পর তার বংশধররা নাম গোপন করে বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে চলে যায়। মাহাদীর নানা এই জিনিসগুলো সেই সময় বস্তাভরে মাটির নিচে পুঁতে রেখেছিলেন। বাবার দেওয়া তথ্য অনুসারে সেই মাটি খুঁড়ে নবাব সিরাজের ব্যবহৃত জিনিসগুলো উদ্ধার করে জনসমক্ষে আনেন মাহাদী।

নিজেকে নবাবের ১১তম বংশধর দাবি করে গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশ-বিদেশে আলোড়ন তোলেন ৭০ বছর বয়সী সৈয়দ মাহাদী। নিজেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলার কন্যা উম্মে জহুরার বংশীয় দাবি করে হঠাৎ করেই জনসমক্ষে আসেন তিনি। সঙ্গে প্রমাণ হিসেবে নিয়ে আসেন পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধ করা নবাব সিরাজউদ্দৌলার তলোয়ার, ব্যবহৃত জুতা, মুকুট, এমনকি পলাশীর যুদ্ধের পরিকল্পনা করা ফারসি ভাষায় লেখা বিভিন্ন নথিপত্র। এমনকি তার কাছে রয়েছে ফারসি অক্ষরে লেখা নবাবের বংশতালিকা। পরবর্তীতে মাহাদীর বাবা সৈয়দ হাফেজ আবদুল্লাহ্ আলী আকবরউদ্দৌলা খাঁ সেই বংশতালিকা বাংলায় অনুবাদ করেন— এমন দাবিও করেছেন মাহাদী।

মাহাদীর দাবি করেন, ব্রিটিশদের ভয়ে আত্মপরিচয় গোপন রেখে নবাব পরিবারের সদস্যরা ভারতর্ষের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে দাদা সৈয়দ মো: শওকত হোসেন আনোয়ার আক্তার ১৮৯৯ সালের ঢাকার নবাব খাজা আহসান উল্ল্যাহর সাথে দেখা করলে তিনি গোপনে তাদের নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে বোনের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। ইংরেজদের ভয়ে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আত্মগোপন করেন। সেসময় তার কাছে থাকা নবাব সিরাজ উদ দৌলার ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী এবং যুদ্ধের তলোয়ারসহ অনান্য সরঞ্জাম বড় পাতিলে ভরে মাটিতে লুকিয়ে রাখেন। তার দাদার মৃত্যুর পর ১৯৮২ সালে কবরস্থানে মাটি খুঁড়ে নবাব সিরাজ উদ দৌলার ব্যবহৃত পোশাকসহ বিভিন্ন সামগ্রী উদ্ধার করেন।

জাদুঘর কর্মকর্তারা যা বললেন

এত প্রমাণের পরও কেন তাকে ‘ভুয়া’ সাব্যস্ত করা হল— এ ব্যাপারে যুক্তি তুলে ধরে জাদুঘরের ডেপুটি কিপার ইলিয়াস খান বলেন, ‘মাহাদী ফারসি ভাষায় বিজ্ঞ ছিলেন। তিনি ফারসি লিখতে ও পড়তে জানেন। আর তার কাছে থাকা নবাব সিরাজের দলিল দাবি করা সকল কাগজই ফারসি ভাষায়। তাই প্রথমে আমরা মাহাদীকে ফারসি ভাষায় নবাব সিরাজের নাম লিখতে বলি একটা কাগজে। পরবর্তীতে আমরা মিলিয়ে দেখলাম তার কাছে থাকা পুরাতন কাগজের লেখা ও মাহাদীর হাতের লেখা অনেকটাই মিল।’

জাদুঘরের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এছাড়াও নবাবের আমলের দলিল দস্তাবেজ দাবি করা কাগজগুলোতে ফারসি ভাষায় যেসব লেখা রয়েছে, সেগুলোতে কোনো অর্থপূর্ণ তথ্য বা কথা নেই। সবগুলোই হাবিজাবি লেখা।’

ইলিয়াস খান বলেন, ‘নবাবরা বা সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজন সেই সময় কোনো বস্তু বা তলোয়ারে নিজেদের নাম ঢালাই করে লিখতেন। কিন্তু মাহাদীর উপস্থাপিত তলোয়ারটিতে নবাব সিরাজের নামটি কোনো সূক্ষ্ম ধাতু দিয়ে খুঁচিয়ে লেখা হয়েছে, যার কোন আভিজাত্যতা নেই। আর তলোয়ারের খোদাই করা ফারসি লেখাটি মাহাদীর হাতের লেখার সাথে মিলে যায়।’

এমনকি নবাব সিরাজের তলোয়ার দাবি করা তলোয়ারটিও সেই সময়ের নয় বলে মন্তব্য করেন জাতীয় জাদুঘরের ডেপুটি কিপার।

জাদুঘর কর্মকর্তার তথ্যমতে, মাহাদীর উপস্থাপন করা তলোয়ারের হাতলের দুপাশে দুটো চুম্বক রয়েছে, যেগুলো মাত্র ৩০-৪০ বছরের পুরনো। এমনকি চুম্বকের গায়ে সেই সালটাও লেখা রয়েছে।

মাহাদীর কাছে থাকা ‘পুরাতন দলিল’গুলো সম্পর্কে জাদুঘরের যাচাই-বাছাই কমিটি জানিয়েছে, ১৬০০ শতাব্দীতে অর্থাৎ সিরাজউদ্দৌলার সময়ে বলপেনের আবিষ্কারই হয়নি। কিন্তু বংশধর দাবি করা মাহাদী যেসমস্ত দলিল নবাব সিরাজের আমলের দাবি করেছেন সেই দলিলগুলোর অনেকগুলোতে বলপেন কলমের ব্যবহার হয়েছে। আর তিন আনার যে দলিলে নবাব সিরাজের বংশতালিকাটি রয়েছে, সেই দলিলটি পুরাতন হলেও আসল নয় বলে অভিমত দিয়েছেন তারা।

এছাড়াও সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৭ সালে যে জুতো পরে যুদ্ধ করেছেন সেটি ছাড়াও তার ব্যবহৃত কাপড় ও মুকুটগুলোও সাম্প্রতিক সময়ের বলে মন্তব্য করেছে কমিটি।

সিরাজের ব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলোকে অধিকতর পরীক্ষার উদ্দেশ্যে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য খালি বক্স নিয়ে এসেছিল জাদুঘরের দলটি। কিন্তু রাউজান থেকে কোন জিনিস না নিয়েই বক্সগুলোকে খালি অবস্থাতেই ঢাকায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

এর কারণ সম্পর্কে যাচাই-বাছাই কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমাদের তিনজনকে প্রাথমিক যাচাই বাছাইয়ের জন্য ঢাকা থেকে রাউজান পাঠানো হয়। আমরা যদি মাহাদীর দেখানো কোনো জিনিসের ওপর বিশ্বাস আসতো, তবে তা আমরা ঢাকায় নিয়ে আমাদের চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই কমিটির কাছে উপস্থিত করতাম। কিন্তু প্রাথমিক যাচাইয়েই যখন আমরা নিশ্চিত হয়েছি এগুলো সব ভুয়া, সেজন্য জিনিসগুলোকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার কোন অর্থই হয় না।’

এখন কী বলছেন সেই মাহাদী?

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত জাতীয় জাদুঘরের কর্মকর্তাদের মন্তব্যের পর নবাবের বংশধর দাবি করা মাহাদী বলেন, ‘যদি জিনিসগুলো আসল না হয় তবে আসলো কোত্থেকে? আমার কাছে কি বানানোর মেশিন আছে? আর আমাকে বাদ দেওয়া মানে সিরাজকে বাদ দেওয়া।’

জাতীয় জাদুঘরের কর্মকর্তাদের মন্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করবেন কিনা জানতে চাইলে মাহাদী বলেন, ‘না, আমি করবো না। আমার কাছে টাকা নেই, ক্ষমতা নেই। আমি শুধু আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম।’

জাদুঘর থেকে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আসা কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে করে তিনি বলেন, ‘যারা ইংরেজদের দালাল তারা কখনো সিরাজকে স্বীকার করবে না। তার বংশধরকেও স্বীকৃতি দেবে না।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!