চট্টগ্রামে সরকারি ডাক্তারদের বেতন নেই তিন মাস, বরাদ্দই নেই

কর্তৃপক্ষের দাবি ‘টেকনিক্যাল সমস্যা’, সফটওয়্যার দেখায় ‘বাজেট সমস্যা’

করোনা শনাক্তের আড়াই মাস চলছে চট্টগ্রামে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ঝুঁকি নিয়ে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সামনে থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা। এ পর্যন্ত চট্টগ্রামে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত ১৭৫ জন চিকিৎসক। কিন্তু সেই ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা চিকিৎসকরা বেতনই পাচ্ছেন না ঠিকঠাক। পর্যাপ্ত বাজেট না থাকায় উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকদের এক থেকে তিন মাস পর্যন্ত বেতন বকেয়া পড়েছে। গত ডিসেম্বরে নিয়োগ পাওয়া ৩৯তম বিসিএসের চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা বেশি। ওই তালিকায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার ৪৭২ জন সরকারি চিকিৎসক রয়েছেন।

বলা হচ্ছে, বরাদ্দ এলেই বেতন মিলবে। কবে নাগাদ বরাদ্দ আসবে আর বেতন কবে মিলবে জানা নেই কোনো চিকিৎসকের। বেতন আসি আসি করে কোনো কোনো চিকিৎসকের এভাবে কেটে গেছে তিন তিনটে মাস— তাও খবর নেই বেতনের।

যেখানে করোনার ভয়ে অর্ধেকের বেশি চিকিৎসক ব্যক্তিগত চেম্বার বন্ধ রেখেছেন, সেখানে ওই চিকিৎসকরাই সরকারি হাসপাতালে ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন মাসের পর মাস। ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের সেবা দিলেও ভাগ্যে জুটছে না কাঙ্খিত পরিশ্রমের মূল্য। আবার ৩৯তম বিসিএসের যাদের পোস্টিং হয়নি, তারা মাস শেষে ঠিকই বেতন পাচ্ছেন। অথচ যারা উপজেলার মাঠপর্যায়ে নিয়োগ পেয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারাই পাচ্ছেন না বেতন।

৩৯তম বিসিএসের মাধ্যমে ৪ হাজার ১৬১ জন চিকিৎসক গত ডিসেম্বরে নিয়োগ পান। তাদের বেতন-ভাতা বাবদ ১৩৮ কোটি টাকা প্রয়োজন হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ অর্থ বরাদ্দের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে। এদিকে গত জানুয়ারি থেকে সব সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের বেতন দেওয়া হচ্ছে ‘আইবিএস++’ নামের একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে। এ সফটওয়্যারে প্রত্যেক চিকিৎসকের নিজস্ব অ্যাকাউন্ট থাকে। নিজস্ব অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতি মাসের বেতন বিল জমা দিতে হয়। টেকনিক্যাল কোন কারণে উপজেলা থেকে সফটওয়্যারে বেতন বিল জমা দেওয়া যাচ্ছে না। বেতন বিল জমা দিতে গেলে ‘ইনসাফিশিয়েন্ট বাজেট বা অপর্যাপ্ত বরাদ্দ’ লেখা আসছে। উপজেলার হিসাব বিভাগ ও সিভিল সার্জন কর্তৃপক্ষও ‘অফ দ্য রেকর্ড’ স্বীকার করে বলছেন, চিকিৎসকদের বেতন বাবদ বরাদ্দ না আসায় এমন সমস্যা হচ্ছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ২০৪ জন। এদের মধ্যে উপজেলায় রয়েছেন ৪৭২ জন, জেনারেল হাসপাতালে আছেন ৫০ জন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ৩০৫ জন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ৩৫০ জন এবং ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডিতে রয়েছেন ২৭ জন চিকিৎসক। যদিও চমেক হাসপাতাল ও কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি তাদের সকল সরকারি চিকিৎসকের বেতন ভাতা পরিশোধ করা হয়েছে। কারও বেতন বকেয়া নেই।

অন্যদিকে, উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে নিয়োগ পাওয়া অধিকাংশ চিকিৎসক ৩৯তম বিসিএসের। বেতন না পেলেও নিরবিচ্ছিন্নভাবে সকলেই করোনা ওয়ার্ডের রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের প্রায় প্রত্যেকের তিন মাস করে বেতন বকেয়া রয়েছে। তারা জানিয়েছেন, চিকিৎসকদের বেতন বকেয়ার বিষয়টি লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। কিন্তু তিন মাসেও কোনো সমাধান হয়নি। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, বেতনের কোনো একটি খাতেও যদি বরাদ্দ না থাকে তাহলে ‘আইবিএস++ সফটওয়্যার’ বেতন বিল জমা নেয় না। মাঠপর্যায় থেকে অর্থ চাহিদা পাঠানোর সময় সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতি হলেও সফটওয়্যারে বেতন আটকে যাচ্ছে। আর উপজেলা থেকে অর্থ চাহিদা পাঠানোর ক্ষেত্রে অসতর্কতার জন্য বেতন আটকা পড়ে আছে।

বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের সবার দুই থেকে তিন মাসের বেতন বকেয়া। টেকনিক্যাল সমস্যা আর বাজেট না থাকায় কর্তৃপক্ষ বেতন দিতে পারছেন না। কিন্তু করোনার এ সময়েও জীবনের মায়া ত্যাগ করে দায়িত্ব নিয়ে রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের অনেক ডাক্তার আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের কয়েকজন মারাও গেছেন। আমাদেরও সংসার আছে। তার ওপর ব্যক্তিগত চেম্বারও বন্ধ। বোঝেন অবস্থা! সময়মতো ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত করলে হয়। প্রণোদনা পাওয়ার বিষয় পরে আসবে।’

একই প্রসঙ্গে চমেক হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ‘বাজেট বরাদ্দ না থাকায় আমাদের অনেক ডাক্তারের বেতন পেতে দেরি হয়েছে। তবে পেয়ে গেছে তারা। এক্ষেত্রে কিছু টেকনিক্যাল প্রবলেম থাকে। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা একটা কোড থাকে। অনেক সময় সমস্যা হয়। তবে বেতনের বেশি সমস্যা হয় উপজেলাগুলোতে।’

এ বিষয়ে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম হুমায়ুন কবির চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার হাসপাতলে এরকম ঘটনা নাই। আমার জানা মতে বেতন সংক্রান্ত কোন সমস্যা নেই। তবে শুনেছি মেডিকেল কলেজে কয়েকজনের নাকি বেতন সংক্রান্ত সমস্যা হয়েছে। আর জানামতে এরকম কোনো কমপ্লেইন আসে নাই। সেটা অন্য কিছু বা বাজেট বরাদ্দ সংকট এমন হতে পারে। নাহলে তো আমার কাছে কমপ্লেইন করার কথা, আর এখন তো অনলাইনে বেতন চলে যায়। তাছাড়া ৩৯তম বিসিএসের কয়েকজন জয়েন করেছে— তাও গত ১১ তারিখে। তাদের বেতন প্রসেস হতে সময় লাগবে। আমাদের এখানে তেমন কোনো ঘটনা নাই, অন্য জায়গায় হতে পারে।’

চিকিৎসকদের বেতনের সমস্যা নেই জানিয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. শামীম হাসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারি হাসপাতাল মানে? হাসপাতালের কথা আমি বলতে পারব না। আমার কলেজে বেতন হচ্ছে। কোন মাসে একটা দিনের জন্যও বাদ যায়নি। কলেজের বেতন কখনও বন্ধ হয়নি। আমরা মে মাসের বেতন সবাই পেয়েছি, হাসপাতালেরটা বলতে পারব না।’

তবে বেতন বকেয়া থাকার বিষয়টি সরাসরি না বললেও সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বির স্বরেও স্বীকারোক্তিই প্রকাশ পেয়েছে। তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের? জেনারেল হাসপাতাল তো আমার না। জানি না, তবে মাঝে মাঝে এমন হয়। আমাদের অ্যাকাউন্ট সেকশনে কিছু ঝামেলা আছে। আমাদের প্রতি তিন মাস, চার মাস পর পর একটা চাহিদাপত্র দিতে হয় যে আমাদের স্টাফদের এত বেতন। মন্ত্রণালয় থেকে সেভাবে বরাদ্দ দেয়। সেখানে চাহিদাপত্রে হয়তো কোন সমস্যা ছিল। যে পরিমাণ টাকা চেয়েছে তার চেয়ে বেশি হয়তো চাওয়ার কথা। এটা হয়তো সমস্যা হয়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটা ঠিক হতে বেশি দিন লাগে না। ঠিক হয়ে যায়, আবার বরাদ্দ দেয়। এক মাস হতে পারে। ওরা তো আমার সাথে কেউ কিছু বলে নাই। শেষ মাস তো একমাস হতে পারে। আমাদের অনলাইনে বেতন হয়। সেখানে ৫০০ টাকা কম হলেও বরাদ্দ নেই বলে। আবার পাঁচ টাকা কম হলেও বরাদ্দ নেই বলে বেতন বন্ধ করে দেয়। ধরেন, চাহিদাপত্র চাওয়া হয়েছে তিন মাসের জন্য পাঁচ লাখ। এখন শেষ মাসে এসে দেখা গেল আমাদের লাগছে পাঁচ লাখ একশো, তখন বেতন বন্ধ করে দেয়, কম্পিউটারাইজড তো। পরে ঠিক হয়ে যায়। একটু সময় লাগে। এখানে কারও দোষ নাই। টেকনিক্যাল সমস্যা। আমাদের অফিসের কয়েকজনের এমন হয়েছে। চিঠি লিখেছি ঠিক হয়ে যাবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!