চট্টগ্রামে মৌসুমী ফলের দাম আগুন, হাত পুড়ছে গরিবেরই

নিম্ন আয়ের মানুষের ঘরে মৌসুমী ফল এখন অনেকটা বিলাসী কারবার। কলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মৌসুমের তরমুজ, পেঁপে, আনারস, আনার ও আঙ্গুরসহ সব ফলের দাম আকাশচুম্বী। কয়েকদিন আগেও একজোড়া কলা বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। ৩ থেকে ৪ কেজি ওজনের তরমুজ বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। অতিরিক্ত দামের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ এসব ফল কিনতে পারছে না।

অন্যদিকে ডাক্তাররা বলছেন, সুস্থ থাকতে নিয়মিত ফল খেতে হবে। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষেরা সুস্থ থাকবে কিভাবে? ‘খাদ্য’ মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। নিম্ন আয়ের মানুষের সে অধিকার রক্ষা করবে কে? পুষ্টি চাহিদা পূরণ না হলে মানুষের গায়ে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়। এমনকি ওসব রোগের কারণে অকালে মারা যায়। তবে কি তারা এভাবেই মরবে? এসব প্রশ্ন সচেতন মহলের। শুধু নিম্নআয়ের মানুষ নয়, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরাও মৌসুমী খেতে পারছে না।

রংপুরের সাইফুল রিকশা চালান চট্টগ্রামে। যা আয় হয় তাতে ৫ সদস্যের সাংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় সাইফুলের। রমজানে তার সন্তানেরা তরমুজ খাওয়ার বায়না ধরেছে। সাইফুল চকবাজারে এসেছেন তরমুজ কিনতে। বিধিবাম তরমুজের দাম শুনে সাইফুল থমকে যায়। পরিবারের নিয়মিত খরচ মেটাতে পারেন না সাইফুল। এতো দামে তরমুজ কেনার সামর্থ্য নেই তার। সাইফুলের অভিযোগ, অতিরিক্ত দামের কারণে ফল কিনতে পারেন না তিনি। শুধু সাইফুল নয়, এমন হাজারও সাইফুল আছে যারা দামের কারণে ফল কিনতে পারছে না।

নগরীর চকবাজার ও বহদ্দারহাট এলাকার বিভিন্ন ভাসমান ফল বিক্রেতা ও স্থায়ী ফলের দোকান ঘুরে দেখেন প্রতিবেদক। দেখা যায়, অনেকেই বিভিন্ন ফলের দাম জিজ্ঞেস করে, দরাদরি করে। দাম কমে না। পরে ফ্যাকাসে মুখে ফল না কিনে চলে যাচ্ছে।

এর উল্টো চিত্রও রয়েছে। অনেকে বিভিন্ন ফলের নাম ও পরিমাণ বলে দিচ্ছে দোকানিকে । পরে হিসাব করে টাকা দিয়ে দোকান ছাড়ছে তারা। একই দোকানে দুইটা চিত্র। তবে ফল কিনতে কিনতে না পেরে ফ্যাকাশে মুখের সংখ্যা অনেক বেশি।

চকবাজারে আকারভেদে কেজিতে কাল আঙ্গুর বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। আনার বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকা থেকে ২৬০ টাকা দরে‌। ছোট আকারের একজোড়া আনারস ১০০ টাকা, এক কেজি পেঁপে ৯০ থেকে ১০০ টাকা, আকারভেদে বেলের জোড়া ৮০ থেকে ১৫০ টাকা, ড্রাগন ফল ৪৪০ থেকে ৪৬০ টাকা, মানভেদে আপেল ১৭০ থেকে ২০০ টাকা, কমলা ১৮০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এসব ফল নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।

আগে ডজন হিসাবে বিক্রি হতো পেয়ারা। এখন সেটি কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। পেয়ারার দামও আগের তুলনায় বেড়েছে অনেক গুণ। বড় সাইজের ৩ থেকে ৪টি পেয়ারার ওজন হয়ে যাচ্ছে ১ কেজি। দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা। গিয়াস উদ্দিন নামের এক ক্রেতা বলেন, ‘আগে ডজন কিনতাম ৩০-৪০ টাকায়। এখন এক কেজি ৬০ টাকা। ড্রাগন ফল দোকানে দেখেছি। কখনো খাওয়া হয়নি। দোকানে নতুন নতুন ফল দেখি। দাম জিজ্ঞেস করার সাহস হয় না। দিনে দিনে নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে যাচ্ছে বাজারের সব ফল।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক সাইফুল ইসলাম ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রত্যেক মানুষের অন্যান্য সবুজ শাকসবজির পাশাপাশি পর্যাপ্ত ফল খাওয়া দরকার। দেশীয় ফলে বিভিন্ন ভিটামিন রয়েছে। যা শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। গর্ভবতী মহিলাদের বেশি পরিমাণে আমিষ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ খাবার এবং পর্যাপ্ত পানি খেতে হবে। না হলে শিশু অপুষ্টিতে ভুগবে।’

একজন মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পর্যাপ্ত সবুজ শাক-সবজি ও ফলমূল খেতে হবে। কিন্তু নিম্নআয়ের মানুষ ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের নাগালের বাইরে বাজারের অধিকাংশ ফল।

জানা যায়, ২০১০ থেকে ২০২০ এর মধ্যে অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৭ লাখ (জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থাসহ অন্যান্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি ২০১৭ শীর্ষক প্রতিবেদন)। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার মতে, এমডিজি সময়কালে বাংলাদেশ খর্বতা, কৃশতা ও কম ওজনসম্পন্ন শিশুর সংখ্যা কমলেও বাংলাদেশে অপুষ্টির হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। অপুষ্টির জন্য মৌসুমী ফল খেতে না পারাকে অন্যতম কারণ বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।

দেশে পুষ্টি পরিস্থিতির অগ্রগতি তেমন সন্তোষজনক নয়। শিশু ও নারীদের মধ্যে অপুষ্টির হার খুব বেশি। তারা ভিটামিন-এ, আয়রন, আয়োডিন, জিংক ইত্যাদি ঘাটতিতে ভুগছে ব্যাপকভাবে। এছাড়া আছে রক্তস্বল্পতার সমস্যা। পুষ্টিবিষয়ক এক সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, ৫ বছর পর্যন্ত শিশুদের শতকরা ৪৪ ভাগের মধ্যে জিংক ঘাটতি বিদ্যমান। অর্ধেকের বেশি মায়ের মধ্যে জিংক ঘাটতি আছে। এদের একটা বড় অংশ দারিদ্র্যপীড়িত এবং অনেকেই বস্তিতে বাস করে। শতকরা ৪০ ভাগের বেশি মায়ের আয়োডিন স্বল্পতা রয়েছে। এছাড়া শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং মায়েদের ভিটামিনের ঘাটতিও উল্লেখযোগ্য।

আরএম/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!