চট্টগ্রামে মৃতদেহ শ্মশানে গেল গাউসিয়ার যুবাদের কাঁধে

কুন্ডেশ্বরীর প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহের শেষকৃত্যানুষ্ঠান

কিডনী, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ শরীরে বাসা বাঁধলেও চিকিৎসা চালিয়ে সুস্থ ছিলেন ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রামভিত্তিক কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের কর্ণধার প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ (পিআর সিনহা)। কিছুদিন আগে কোভিড আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু করোনা থেকে বাঁচতে পারলেন না তিনি।

বৃহস্পতিবার (৩ ডিসম্বর) সন্ধ্যা ৭টায় নগরীর ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮০ বছরে এসে জীবনের কাছে হার মানেন প্রফুল্লু রঞ্জন সিংহ।

খবর পেয়ে গাউছিয়া কমিটির সদস্যরা শুক্রবার সকালে গিয়ে তাদের নিজস্ব এ্যাম্বুলেন্স করে লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে শেষকৃত্যানুষ্ঠানের সব আয়োজন করেন। ছুটে আসেন স্থানীয় গাউছিয়া কমিটির সদস্যরাও। লাশ অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানো, গোসল দেওয়া থেকে শুরু করে শেষকৃত্যের সব কাজ করেন এই সংগঠনের কর্মীরা।

গাউছিয়া কমিটির লাশ দাফন কাজের সমন্বয়ক মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার বলেন, ‘প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ মারা যাওয়ার পর তাঁর ছেলে রাজীব সিংহ আমাকে ফোন করে সৎকার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে অনুরোধ জানান। বৃহস্পতিবার রাতেই ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে যাই আমি। শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে আমাদের সংগঠনের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স যোগে প্রফুল্ল রঞ্জনের লাশ রাউজানের গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়। সেখানে কুন্ডেশ্বরী প্রাঙ্গণে তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। তারপর তারা সৎকার কার্যক্রম শুরু করেন। লাশের গোসল শেষে পোশাক পরিয়ে খাটিয়ায় তুলে মরদেহ চিতায় পাঠানো হয়। সৎকারের শেষ পর্যন্ত গাউছিয়া কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘খবর পেয়ে স্থানীয় গাউছিয়া কমিটির সদস্যরাও কুন্ডেশ্বরী প্রাঙ্গণে হাজির হয়েছিলেন সৎকার কার্যক্রম ভালোভাবে সম্পন্ন করার জন্য।’

প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহের ছেলে রাজীব রঞ্জন সিংহ জানান, তাঁর বাবার লাশ গোসল ও শেষকৃত্যের সব কাজ করেন গাউসিয়া কমিটির স্বেচ্ছাসেবীরা। তাদের এই সহযোগিতা তাঁর কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

রাজীব সিংহ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার বাবা সারা জীবন মানুষের জন্য কাজ করেছেন। সব ধর্মের মানুষকে একই চোখেই দেখেছেন।’

প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ তার পিতা শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহসহ রাউজানে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাহিনীর হাতে নির্মম অত্যাচারে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন।

প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহের যুদ্ধাপরাধবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অন্যতম সাক্ষী ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সাকা চৌধুরী পাকবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে কুন্ডেশ্বরীর প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা করে।
চট্টগ্রামে মৃতদেহ শ্মশানে গেল গাউসিয়ার যুবাদের কাঁধে 1
রাউজানে কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, সুলতানপুর ও ঊনসত্তরপাড়ায় হিন্দু বসতিতে গণহত্যা এবং হাটহাজারীর এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার ছেলেকে অপহরণ করে খুনের চার অভিযোগে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় দেয় মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ১ ডিসেম্বর ছিল শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের ১২০তম জন্মবার্ষিকী। এর একদিন পরই ছেলে প্রফুল্ল মারা গেলেন। মৃত্যুকালে প্রফুল্লু রঞ্জন সিংহ স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক পুত্র রেখে গেছেন।

এদিকে গাউছিয়া কমিটির দাফন, সৎকার এবং রোগীসেবার প্রধান সমন্বয়ক মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার জানান, ধর্মবর্ণের ভেদাভেদ ভুলে এভাবে দিনরাত করোনায় আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ দাফন ও সৎকারে ছুটে চলেন তাঁরা।

করোনাসংকট শুরু হওয়ার পর থেকে গত ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৫১৯টি লাশ দাফন ও সৎকার করেছে সংগঠনটি। ১ হাজার ৫১৯ জনের মধ্যে ২২ জন ছিলেন হিন্দু ও বৌদ্ধ।

করোনাসংকটের শুরুতে সংগঠনটির কর্মীরা নিজ নিজ এলাকার উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত লাশ দাফনকাজের প্রশিক্ষণ নেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি অনুসারে সুরক্ষা পোশাক পরে দাফনকাজ সম্পন্ন করা হয়।

১৯৮৬ সালে চট্টগ্রামের আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহ.) এই গাউসিয়া কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের তত্ত্বাবধানে দেশে ২০০ এর বেশি মাদ্রাসা পরিচালিত হয়। সারা দেশে এই সংগঠন সামাজিক ও ধর্মীয় কাজ করে। দেশের ৫০ জেলায় রয়েছে তাঁদের সংগঠনের বিস্তার। উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে এই সংগঠনের প্রায় ৭০০ কর্মী করোনায় মৃতদের দাফনে কাজ করছেন।

এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!