চট্টগ্রামে ভবন বানাতে সহকর্মীর হাতে টাকা দিয়ে ১১ সৌদিপ্রবাসী বড় প্রতারণার ফাঁদে

ফ্ল্যাটের দখল দিতে ১০ লাখ টাকা করে চাঁদা চায় কথিত ‘সমাজকর্মী’

বিদেশে মরুর বুকে ঘাম ঝরানো শ্রমের বিনিময়ে আয় করা টাকা দেশে বিনিয়োগ করতে এক হয়েছিলেন সৌদি আরবে কাজ করা চট্টগ্রামের ১২ প্রবাসী। পরিকল্পনা ছিল তাদের বিনিয়োগে চট্টগ্রাম শহরে একটা জায়গায় ভবন নির্মাণ করে জায়গার মালিককে ভবনের অর্ধেক দিয়ে বাকি অর্ধেক নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেবেন তারা।

এই পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে নিজেদের প্রতিনিধি হিসেবে একজনকে পুরো প্রকল্প তদারকির দায়িত্বও দেন তারা। নির্মাণ ব্যয় বহনের পাশাপাশি সেই তদারকির জন্য প্রতি স্কয়ার ফিটে তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রবাসীকে ৩০০ টাকা করে কমিশন দেওয়ার সিদ্ধান্তও হয় তাদের। এসব শর্তে চুক্তি করে ভবন নির্মাণ হলেও নির্মাণ কাজের শেষ পর্যায়ে এসে বেঁকে বসেছেন তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রতিনিধি।

হাজী মো. সেলিম উদ্দিন নামের ওই প্রবাসী বাকি ১১ প্রবাসীদের এখন বলছেন, বাজারমূল্য অনুযায়ী ফ্ল্যাটগুলো বুঝে নিতে হবে তাদের। ওই প্রবাসীরা বিনিয়োগ ও চুক্তির বিষয় স্মরণ করিয়ে দিয়ে আলোচনা করার প্রস্তাব দিলে তাদের এক শব্দে সেলিম উদ্দিন জবাব দিচ্ছেন এই বিষয়ে কোন আলাপ আলোচনাতেই আগ্রহ নেই তার। বাজারমূল্যে কেনার আগ্রহ না থাকলে আদালতে এই বিষয়ে সুরাহা করার কথাই শুধু বলছেন হাজী সেলিম।

এদিকে সরল বিশ্বাসে দীর্ঘদিনের শ্রমের টাকা সহকর্মীর হাতে তুলে দিয়ে এমন প্রতারণার শিকার হওয়া প্রবাসীরা বলছেন, দেশে কিছু খারাপ মানুষের কুপরামর্শে আইনি ফাঁকফোকর তৈরি করে তাদের জিম্মি করছেন হাজী সেলিম। তারা বলছেন, সংঘবদ্ধ একটি প্রতারক চক্রের সহযোগিতা নিয়ে দেওয়ানী মামলার জটিলতার ফাঁদে ফেলে তাদের হয়রানি করছেন হাজী সেলিম।

এই চক্রে স্থানীয় রাজনৈতিক ক্যাডারসহ বিভিন্ন পেশাজীবী ব্যক্তিও আছেন বলে অভিযোগ হয়রানির শিকার হওয়া এসব প্রবাসীর। এই হয়রানি মোকাবেলা করার সময় ও মানসিক শক্তি কোনোটাই নেই উল্লেখ করে তারা বলছেন, হয়রানির হাত থেকে মুক্তি পেতে প্রবাসী কল্যাণ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা চান তারা। অন্যদিকে ১১ প্রবাসীর এমন অভিযোগ অস্বীকার করে হাজী সেলিম বলছেন, নিজের টাকায় এই ভবন তৈরি করেছেন তিনি।

প্রতারণার শিকার হওয়া সৌদি আরব প্রবাসী হারুন উর রশীদ চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মক্কা ও জেদ্দায় বসবাসরত চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের একটা সংগঠন আছে আমাদের। আরব চট্টগ্রাম বিল্ডার্স ইনভেস্টমেন্ট প্রা. লি. নামের সেই সংগঠনের সভাপতি হলেন মিজান ভাই এবং সাধারণ সম্পাদক সেলিম ভাই। সেলিম ভাই ২০১৭ সালের দিকে মিজান ভাইকে বলেন, চট্টগ্রামের চট্টেশ্বরী রোডে ১০ শতক জায়গা আছে যেখানে আমরা বিনিয়োগ করতে পারি। এজন্য আমরা ইনভেস্ট করবো। ল্যান্ড ডোনার পুরো প্রকল্পের অর্ধেক পাবে। আর আমরা প্রত্যেকে একটি করে ফ্ল্যাট নেবো। সেই ফ্ল্যাটের জন্য আমরা নির্মাণ ব্যয়ের (প্রতি স্কয়ার ফিট ২৬০০ টাকা) পাশাপাশি ৩০০ টাকা করে কমিশন দেব। এই টাকা কাজ যারা দেখবে, তারা নেবে। সেই রকম একটা চুক্তিও হয়েছিল আমাদের। চুক্তি অনুযায়ী আমরা উনাকে ধাপে ধাপে নির্মাণ ব্যয় বাবদ টাকা দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি নিজে প্রায় ৪০ লাখ টাকার মত দিয়েছি।’

সংকট শুরুর বিষয়টি তুলে ধরে হারুন উর রশীদ চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের চুক্তিতে স্পষ্ট লেখা ছিল নির্মাণ ব্যয়ের পাশাপাশি আমরা ৩০০ টাকা করে দেবো। কাজ শেষ হয়ে আসলে এই কথা থেকে একদম সরে যান সেলিম ভাই। তিনি বলছেন প্রতি স্কয়ার ফিট ৪ হাজার টাকা দিয়ে আমরা কিনে নিতে হবে। এখন এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইলেও তিনি কথা বলছেন না। তিনি বলছেন আদালতে গিয়ে মামলা করতে। আমরা সেখানে গেলে স্থানীয় সন্ত্রাসী দিয়েও তিনি আমাদের হুমকি ধামকি দিচ্ছেন।’

হারুন উর রশীদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আরব চট্টগ্রাম বিল্ডার্স ইনভেস্টমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেডের সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টা সত্য। আমরা সকলেই ভাই-বন্ধু। এখানে একসাথে কাজ করি। এই জায়গাটা সেলিম ভাই দেখেছেন। উনি আমাকে বলেছেন। আমি বাকিদের এখানে যুক্ত করেছি। কথা ছিল এই পাওয়ারটা আমার নেওয়ার। কিন্তু ভিসা জটিলতায় আমি যেতে না পারায় আমরা উনাকে এই পাওয়ার নিতে বলি। কতটা ভাল সম্পর্ক থাকলে এভাবে বিশ্বাস করা যায় ভাবুন। সেই মানুষটা এখন কারও সাথে কথা বলতেও রাজি না। আসলে আমার ভাইটা লোভে পড়ে গেছেন।’

মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি আল্লাহ উনাকে হেদায়েত দিন। যা বুঝলাম উনি কিছু খারাপ লোকের পাল্লায় পড়েছেন। কিন্তু ওদের কাছেও সব প্রমাণ আছে। এখন যারা তাকে বুদ্ধি পরামর্শ দিচ্ছে তারা এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাচ্ছে যে দেওয়ানি মামলার দীর্ঘসূত্রতা মোকাবেলা করার মানসিক শক্তি বা সময় কোনোটাই প্রবাসীদের নেই। এজন্যই পরিকল্পিতভাবে একটা হয়রানি তৈরি করা হচ্ছে। আমরা প্রবাসীরা খুব কষ্ট করে টাকা উপার্জন করি। সেই টাকা দেশে বিনিয়োগ করতে গিয়ে এমন হয়রানির মুখে যারা আমাদের ফেলছেন তারা আইনি ফাঁকফোকর হয়তো দেখাতে পারবেন। তবে নৈতিকভাবে খুব খারাপ কাজ করছেন।’

হারুন উর রশীদ চৌধুরী ছাড়াও এই প্রকল্পে বিনিয়োগকারী আরেক প্রবাসী হারুন উর রশীদের পক্ষে এই বিষয়গুলো দেখাশোনা করছেন তার ভাগ্নে মিনহাজ চৌধুরী। এই প্রক্রিয়ায় হাজী সেলিমের সাথে স্থানীয় রাজনৈতিক ক্যাডাররাও এক হয়েছে জানিয়ে মিনহাজ চৌধুরী বলেন, ‘হাজী সেলিম কারও সাথে কথা বলতে বা শুনতে রাজি না। এসবে তাকে ইন্ধন দিচ্ছে আকরাম হোসেন নামে একজন। তার কাজই এসব ধান্ধাবাজি। সে আমাকে ডেকে আমার কাছে ১০ লাখ টাকা চেয়েছে। বলেছে এত কিছুর দরকার নাই। ফ্ল্যাটপ্রতি আমাকে ১০ লাখ করে দাও। আমি সব ঠিক করে দেবো।’

তবে এ সবকিছুই অস্বীকার করে হাজী সেলিম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কারও সাথে কোন চুক্তি হয়নি আমার। আমি নিজের টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট বানিয়েছি। এখন তাদের স্কয়ারফিট ৪ হাজার টাকা দিয়ে কিনতে হবে। চট্টগ্রামে আপনি বাজার যাচাই করেন। তারা যে দামে বলতেছে সেই দামে ফ্ল্যাট পাওয়া যায় কিনা?’

এক্ষেত্রে মিনহাজ চৌধুরী তাকে হুমকি দিয়েছেন দাবি করে হাজী সেলিম বলেন, ‘মিনহাজ আমাকে হুমকি-ধামকি দিয়েছে। বলেছে আমাকে মারবে-ধরবে। আমি তো তাকে চিনিও না।’

এই প্রকল্পের সাথে জনৈক আকরাম হোসেনের কী সম্পর্ক জানতে চাইলে হাজী সেলিম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আকরাম আমার বন্ধু। সে আমাকে সাহায্য সহযোগিতা করছে।’

এদিকে দৃশ্যপটে হঠাৎ উদয় হওয়া আকরাম হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘সেলিম আমার বন্ধু হওয়ায় আমি তাকে সহযোগিতা করছি। তারা মনে করছে আমার পাওয়ারে সেলিম এসব করছে। তাই তারা আমার বিরুদ্ধে এসব কথা বলছে। ভাবছে আমাকে সরাতে পারলে সেলিম তাদের কথা শুনবে। আমি একজন সমাজকর্মী। চট্টগ্রাম উন্নয়ন ফোরামের আমি যুগ্ম আহ্বায়ক।’

কিছুক্ষণ পরেই চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে কল করেন হাজী সেলিমের আইনজীবী মামুন জোয়ার্দার। হাজী সেলিমের সঙ্গে কোনো চুক্তি হয়নি জানালেও তার আইনজীবী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চুক্তিটা আপনি ভাল করে পড়েন। সেখানে দেখবেন চাহিবামাত্র টাকা না দিলে উকিল নোটিশ দিয়ে তাদের ফ্ল্যাট বরাদ্দ বাতিল করা যাবে। বাকি প্রবাসীরা পার্টনার নন বরং ফ্ল্যাটগ্রহীতা। আর ফ্ল্যাটগ্রহীতারা বাজারমূল্যেই কিনে নেবেন— এটাই স্বাভাবিক।’

তবে আইনজীবী মামুন জোয়ার্দারের এমন দাবিকে উদ্দেশ্যমূলক দাবি করে প্রতারণার শিকার প্রবাসী হারুন অর রশীদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের চুক্তিতে স্পষ্ট লেখা আছে নির্মাণ ব্যয়ের পাশাপাশি ৩০০ টাকা কমিশন দেব। উনি যে আইনি ফাঁকফোকর দেখাচ্ছেন উনি এটা জানেন না ফ্ল্যাটগ্রহীতারা নির্মাণ ব্যয় হিসেব করে টাকা দেয় না। নির্মাণ ব্যয় তারাই দেয়, যারা পার্টনার। উনার এই পয়েন্টেই তো উনার মানসিকতা বোঝা যাচ্ছে।’

টাকা না দেওয়ায় তাদের ফ্ল্যাট বরাদ্দ বাতিলের বিষয়টি সম্পর্কে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আমি ৪০ লাখ টাকা দিয়েছি। টাকা তো আমি এখনও দিতে রাজি। কিন্তু নির্মাণব্যয় না জানলে আমি টাকাটা দেব কিভাবে? সেলিম ভাই তো কোন হিসেব দিচ্ছেন না। খালি টাকা চাচ্ছেন। এজন্য আমরা চাই তিনি আমাদের সাথে বসুক। আমরা চাই সমাধান। কিন্তু তিনি তো হয়রানি চাচ্ছেন।’

তবে প্রবাসীদের বিনিয়োগের পরিবেশের জন্য এসব ঘটনা খুব নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে মন্তব্য করে সরকারের প্রবাসী কল্যাণ সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপে এই হয়রানির হাত থেকে ১১ প্রবাসীকে মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে আরব চট্টগ্রাম বিল্ডার্স ইনভেস্টমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেডের সভাপতি মিজান বলেন, ‘দেখুন প্রবাসীরা এখানে খুব কষ্ট করে টাকা উপার্জন করে। দেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে আমাদের এমন হয়রানির মুখে ফেলাটা খুব অন্যায়। এই যে হয়রানি এগুলো মোকাবেলা করার সুযোগ কই আমাদের। আমরা এজন্য চাই সংশ্লিষ্ট মহলের হস্তক্ষেপে সবাইকে নিয়ে বসে এই সমস্যার একটা যৌক্তিক সমাধান করে দেওয়া হলে সকলের জন্যই ভাল।’

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!