চট্টগ্রামে বড় বিপদ ডেকে আনছে বাতাসের বিষ ও শব্দের তাণ্ডব

নগরে শব্দের দূষণ দ্বিগুণ, বাতাসের দূষণ আট গুণ

চট্টগ্রাম নগরীতে গোপন ঘাতক হয়ে দাঁড়িয়েছে দুই দূষণ— শব্দ ও বায়ু। এই দুই দূষণই এখন রীতিমতো আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছেছে বলে সাম্প্রতিক এক জরিপ থেকে জানা গেছে। এতে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন স্থানে সাধারণভাবে শব্দের তীব্রতা গ্রহণযোগ্য মাত্রার থেকে প্রায় দেড় থেকে দুই গুণ বেশি। অন্যদিকে এলাকাভেদে প্রধান সড়কগুলোর পাশে নির্ধারিত মাত্রা থেকে প্রায় দুই থেকে আট গুণ বেশি দূষিত হচ্ছে বায়ু।

চট্টগ্রাম নগরীতে এসে ঢাকার স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) একদল গবেষক এই জরিপ পরিচালনা করে।

গবেষক দলটি চট্টগ্রামের হাসপাতাল ও ক্লিনিক, স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, গির্জা, ১০টি আবাসিক এলাকা, ১০টি বাণিজ্যিক এলাকা, ১০টি মিশ্র এলাকা, ১০টি বিভিন্ন ধরনের কারখানা ও শিল্প এলাকা এবং ১০টি ব্যস্ততম রাস্তার সংযুক্তিপূর্ণ এলাকা ও মোড় এবং তুলনামূলক পর্যালোচনা জন্য ১০টি গ্রামীণ পরিবেশের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে।

চট্টগ্রাম নগরীতে যানবাহনের হর্ন সবচেয়ে বেশি শব্দ দূষণ করছে বলে এই গবেষণায় উঠে আসে। প্রাথমিকভাবে শব্দ দূষণের উৎস হিসাবে গবেষক দল যানবাহন চলাচলের শব্দ (হর্ণ, ইঞ্জিন ও চাকার কম্পন), বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের শব্দ, রাস্তার নির্মাণ, খোঁড়াখুঁড়ি ও মেরামতের কাজ, ভবন ও অন্যান্য নির্মাণ কাজের মধ্যে ইট ও পাথর ভাঙ্গা মেশিন ও টাইলস কাটার মেশিনের শব্দ, ভবন ভাঙ্গার শব্দ, কলকারখানার শব্দ, জেনারেটরের শব্দ, সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের মাইকিং ইত্যাদিকে চিহ্নিত করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দূরদূরান্ত থেকে যাওয়া পর্যটকরা বিনোদনের জন্য উচ্চমাত্রার সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করায় চট্টগ্রামের শব্দ দূষণ হচ্ছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

নগরের বিভিন্ন স্থানে সাধারণভাবে যেখানে শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫০ থেকে ৬০ ডেসিবেলের মধ্যে থাকার কথা, সেখানে এই গবেষণায় অধিকাংশ স্থানে তার প্রায় দেড় থেকে দুই গুণ বেশি শব্দের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে অধিকাংশ আবাসিক এলাকা ও গ্রামীণ পরিবেশে শব্দের পরিমাণ মাত্রার মধ্যেই ছিল। রাস্তার ওপরে বা রাস্তার পাশের স্থানগুলোতে সবচেয়ে বেশি শব্দ দূষণ লক্ষ করেছে গবেষক দলটি।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম নগরীতে বায়ু দূষণের উৎসগুলোর মধ্যে যানবাহনের কালো ধোঁয়া, অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িকে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে গবেষক দলটি। বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরের প্রায় অর্ধেক রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, সংস্কার বা বর্ধিতকরণের আওতায় আছে। দীর্ঘদিন ধরে এই কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার কারণে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যায় পরিণত হচ্ছে বায়ু দূষণ।

চট্টগ্রাম নগরীতে ঢাকার স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষকরা।
চট্টগ্রাম নগরীতে ঢাকার স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষকরা।

এছাড়া নগরীর হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, সমুদ্র সৈকতসহ যেখানে সেখানে গতানুগতিক পদ্ধতিতে বারবিকিউ করার জন্য উম্মুক্তভাবে কাঠ ও কয়লা পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া থেকে প্রচুর পরিমাণে বায়ু দূষিত হচ্ছে।

শব্দ ও বায়ু দূষণের উৎস, পরিমাণ এবং ক্ষতিকারক দিকগুলো নির্ণয়ে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় স্বয়ংক্রিয় বিভিন্ন যন্ত্রের সাহায্যে তথ্য সংগ্রহ করে। দুই দিনব্যাপী এই কার্যক্রমে অংশ নেয় ১৭ সদস্যের গবেষক দল। এর নেতৃত্ব দেন ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক প্রফেসর ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার।

ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার শব্দ দূষণ রোধের জন্য চট্টগ্রামকে হর্নমুক্ত নগরী হিসেবে ঘোষণার পরামর্শ দেন। সেই সঙ্গে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী চিহ্নিত জোনসমূহে (নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র) সাইনপোস্ট উপস্থাপন করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। বায়ু দূষণ রোধের জন্য রাস্তার নির্মাণ ও সংস্কার কাজ স্বল্প সময়ে শেষ করার পাশাপাশি নির্মাণের কাজ চলাকালে নির্মাণ স্থান এবং নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এছাড়া নগরীর সড়কগুলোতে সকাল বিকাল নিয়মিতভাবে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।

প্রফেসর মজুমদার জানান, ‘জরিপ পর্যবেক্ষণের অংশ হিসেবে হর্ন গণনা করে দেখা গেছে, বিপণি বিতানগুলোর সামনের রাস্তাগুলোতে সবচেয়ে বেশি হর্ন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে নগরীর ব্যস্ত সড়কগুলোতে সাধারণ হর্নের সাথে সাথে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের আধিক্য লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল কর্তৃক অতিমাত্রায় হর্ন দেওয়া গবেষকদলের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এমন অতিমাত্রার শব্দদূষণের কারণে রাস্তায় চলাচলকারী পথচারী, পর্যটক, ট্রাফিক পুলিশ, হকার, শিশু, সন্তানসম্ভবা মহিলা এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের কানের পর্দা ফেটে যাওয়াসহ সাময়িক বধিরতা থেকে স্থায়ী বধিরতার শঙ্কা আছে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!