চট্টগ্রামে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সেই রোগীর ওষুধ শুরু, হবে জটিল অপারেশনও

চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো শনাক্ত ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের রোগীর সংক্রমণ এখন পর্যন্ত চোখেই সীমাবদ্ধ থাকলেও শরীরের অন্য জায়গায় ছড়ানো ঠেকাতে দ্রুত জটিল একটি অপারেশন করার কথা ভাবছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ডাক্তাররা। এদিকে শনিবার (৩১ জুলাই) থেকে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের একমাত্র ওষুধ ‘অ্যামফোটেরিসিন-বি’ ইনজেকশন দেওয়া শুরু হয়েছে ওই নারীকে। তবে এখন পর্যন্ত পাওয়া ইনজেকশনগুলো দিয়ে চলবে মাত্র চারদিন। আরও ১১ দিন এই ইনজেকশন দিতে হবে তাকে— যা এখন পর্যন্ত জোগাড় করা যায়নি।

ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের ওই নারী রোগী বর্তমানে চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন।

ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ বলেন, ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে এখন পর্যন্ত তার চোখে রয়েছে। এটি যাতে তার নাক ও মুখে নতুন করে না ছড়ায়, তাই একটি জটিল অপারেশন করতে হবে।’

জানা গেছে, পাশের দেশ ভারতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত রোগীদের ৫০ শতাংশই মারা যাচ্ছে। আর যারা বেঁচে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে একটি অংশের চোখ অপসারণ করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকরা বলছেন, এই সংক্রমণের তীব্রতার ওপর এই রোগের চিকিৎসা নির্ভর করে। যেমন মাইল্ড রোগী, মডারেট রোগী এবং সিভিয়ার রোগী। ধরন অনুযায়ী কখনও কিছু ওষুধে কাজ হয়, আবার তীব্রতা বেশি হলে ইনজেকশনও দিতে হয়।

এদিকে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের এখন পর্যন্ত একমাত্র কার্যকরী চিকিৎসা ‘অ্যামফোটেরিসিন-বি’ ইনজেকশন দেশের কোথাও মিলছে না। চট্টগ্রামের পটিয়ার একটি বনেদি ব্যবসায়ী পরিবারের গৃহকর্ত্রী ওই নারীর সন্তানরা রাতদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেও ওষুধটির হদিস পাচ্ছেন না। শেষপর্যন্ত শুক্রবার (৩০ জুলাই) রাতে ঢাকায় গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পর বিকন ফার্মাসিউটিক্যাসের তৈরি ২টি এবং ভারতীয় একটি কোম্পানির তৈরি ২০টি ভায়াল পাওয়া গেছে। চমেক হাসপাতালের চিকিৎসকরা প্রতিদিন ৫ ভায়াল করে ১৫ দিন এই ইনজেকশনটি প্রয়োগের নির্দেশনা দিয়েছেন ওই রোগীকে। ফলে এই ইনজেকশনের আরও ৭৫ ভায়াল জোগাড় করতে হবে ওই নারীর পরিবারকে। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেশের কোথাও থেকে প্রাপ্তির নিশ্চয়তা পাননি।

চিকিৎসা কেন এতো ব্যয়বহুল

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকোরমাইকোসিসজনিত রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। এর মূল কারণ ওষুধের দাম এবং নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের সেবা। ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধও তৈরি করে দেশের একটিমাত্র কোম্পানি। সেই ওষুধের কাঁচামাল আসে ভারত থেকে। তবে সেখানেও এখন কাঁচামাল সহজলভ্য নয়। ফলে বাংলাদেশে এখন অনেকটা সাধারণ চিকিৎসাই চালিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা।

ওষুধের দাম বেশি হওয়া এবং ধারাবাহিক আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হয় বলে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। তবে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ওই ধরনের ইনজেকশন টাকা দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না, যেমনটি ঘটছে চট্টগ্রামে শনাক্ত ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের রোগীর ক্ষেত্রে।

গত মে মাস থেকে আনিসুর রহমান নামে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্ল্যাক ফাঙ্গাস আক্রান্ত এক রোগীর চিকিৎসা হয়েছে ‘অ্যাম্ফোটেরিসিন বি’ ইনজেকশনের মাধ্যমে। চিকিৎসকরাও বলেছেন, এই ইনজেকশনটিই ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের একমাত্র কার্যকরী চিকিৎসা। ৬৪ কেজি ওজনের আনিসুর রহমানকে এই ইনজেকশনটি ৩০০ মিলিগ্রাম দিতে হয়েছে, যার দৈনিক মূল্য ৯০ হাজার টাকা। যদিও তার স্বজনরা সামান্য ছাড়ে দৈনিক ৭২ হাজার টাকায় কিনেছেন ইনজেকশনটি। রোগীভেদে ৩০ থেকে ৬০ দিন এই ইনজেকশন দিতে হয়। অর্থাৎ ২৭ থেকে ৫৪ লাখ টাকার শুধু ইনজেকশনই দিতে হয়।

বাংলাদেশে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইনজেকশন তৈরি করে কেবলমাত্র বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস। এই ওষুধের ৫০ মিলিমিটার পরিমাণের একটি ভায়ালের খুচরা মূল্য প্রায় ১৫ হাজার টাকা। তবে বর্তমানে এই ওষুধের উৎপাদন যেমন নেই, বাজারেও এটি আর মিলছে না। আবার এই ওষুধ তৈরি করতে বিশেষ ব্যয়বহুল প্রযুক্তি ও দামি কাঁচামাল ব্যবহার করতে হয় বলে অন্য ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধটি তৈরি করতেও আগ্রহী নয়।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক অবশ্য ইতিমধ্যে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিকে নির্দেশনা দিয়েছেন, তারা যাতে এই ফাঙ্গাসের ওষুধ তৈরির প্রস্তুতি নেয়।

ছোঁয়াচে নয়, তবে সাবধান!

চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, প্রতি এক লাখে ২০ থেকে ৩০ জনের ব্ল্যাক ফাঙ্গাস হতে পারে। তবে এই রােগ ছোঁয়াচে নয়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, বিশেষত কিটো অ্যাসিডােসিসে আক্রান্তরা, ক্যান্সারে আক্রান্ত রােগী, অতিরিক্ত বা অপ্রয়ােজনীয় ব্রড-স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়ােটিকের ব্যবহার অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অত্যধিক মাত্রায় বা অপ্রয়োজনীয় স্টেরয়েড গ্রহণ করা, কিডনি বা অন্যান্য অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা রােগী এবং চরম অপুষ্টিজনিত রােগী, চামড়ায় গভীর ক্ষত ও পােড়া ঘায়েও এই রােগ হতে দেখা যায়। করোনাভাইরাসে দীর্ঘমেয়াদে আক্রান্ত বা চিকিত্সাধীন রােগী এতে আক্রান্ত হতে পারেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেছেন, মিউকর ছত্রাকের হাইফাগুলাে মানুষের রক্তনালীগুলোতে আক্রমণ করে, যা থেকে থ্রম্বোসিস ও টিস্যু ইনফেকশন, নেক্রোসিস এবং পরিশেষে গ্যাংরিন তৈরি করে। সুস্থ মানুষের রক্তে শ্বেত রক্তকণিকা বা নিউট্রোফিল এ ছত্রাকের বিরুদ্ধে মূল প্রতিরক্ষার কাজ করে থাকে। সুতরাং নিউট্রোপেনিয়া কর্মহীনতায় (যেমন : ডায়াবেটিস, স্টেরয়েড ব্যবহার) বা এইডস আক্রান্তরা সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন।

তিনি বলেন, আক্রান্ত অঙ্গের ওপর ভিত্তি করে মিউকরমাইকোসিস রােগটি ছয় ধরনের হলেও রাইনাে-অরবিটাল-সেরেব্রাল রােগ নাক, নাকের ও কপালের সাইনাস, চোখ ও ব্রেইন বা মস্তিষ্কের সংক্রমণ করে বলে এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। তাতে ফুসফুসীয়, আন্ত্রিক ত্বকীয় সংক্রমণও হতে পারে। আক্রান্ত অংশ আর নাকের শ্লেষ্মা, কফ, চামড়া ও চোখ কালাে রঙ ধারণ করে বলে একে ‘কালাে ছত্রাক’ নামে ডাকা হয়। আক্রান্তদের মধ্যে দ্রুত এবং সঠিক চিকিৎসা না করতে পারলে ৫০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ রােগী মৃত্যুবরণ করে থাকে। আর সংক্রমণে মৃত্যুর হার ১০০ শতাংশ।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!