চট্টগ্রামে ব্যাংকারের আত্মহত্যা ঘিরে জট পাকাচ্ছে রহস্য—মিলছে না কোনো উত্তর

চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকের আত্মহত্যাকে ঘিরে রহস্যের দানা জট পাকাচ্ছে। নিহতের স্ত্রী বলছেন, ব্যবসায়িক পার্টনারদের অনৈতিক চাপ, অতিরিক্ত টাকা আদায়, শারিরিক ও মানসিক নির্যাতনে বাধ্য হয়ে তার স্বামী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কিন্তু স্বামী যখন এমন মানসিক অস্থিরতায় দিন কাটাচ্ছেন তখন স্ত্রী দীর্ঘসময় ধরে ছিলেন বাপের বাড়ি।

কিন্তু ঘটনার তিনদিন পর সংবাদ সম্মেলনে এসে নিহতের স্ত্রী অভিযোগের তীর ছুঁড়ছেন তার স্বামীর ব্যবসায়িক পার্টনার ও কয়েকজন রাজনীতিকদের প্রতি। যদিও মামলায় শুধু কয়েকজন ব্যবসায়িক অংশীদারের নামই রয়েছে।

প্রশ্ন ওঠছে, কেন স্ত্রী স্বামীর দুঃসময়ে পাশে ছিলেন না, কিন্তু হঠাৎ সংবাদ সম্মেলনই বা কেন।

যেভাবে আত্মহত্যা
চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক আব্দুল মোরশেদ চৌধুরী। গত ৭ এপ্রিল শহরের হিলভিউ আবাসিক এলাকার একটি ফ্ল্যাট থেকে আব্দুল মোরশেদ চৌধুরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় পুলিশ একটি সুইসাউডাল নোট উদ্ধার করে। পুলিশ জানায়, প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি, ব্যবসায়িকভাবে অর্থনৈতিক ও মানসিক চাপে ছিলেন মোরশেদ চৌধুরী। সে কারণে আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন।

ঘটনার পরদিন ৮ এপ্রিল দুপুরে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় নিহতের বড় ভাই বাদি হয়ে ৪ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। এতে মোরশেদের ব্যবসায়িক পার্টনার জাবেদ ইকবাল, পারভেজ ইকবাল, নাইম উদ্দিন সাকিব ও যুবলীগ নেতা শহীদুল হক চৌধুরী রাসেলকে আসামি করা হয়।

কোথায় ছিলেন স্ত্রী
মোরশেদ যখন আত্মহত্যার মতো কঠিন পথ বেছে নেয় তখন তার স্ত্রী ইশরাত জাহান বাসায় ছিলেন না। আড়াই মাস আগে স্বামীর সাথে ঝগড়া করে ইশরাত জাহান চৌধুরী বাবার বাড়িতে থিতু হয়েছিলেন। আড়াই মাস বাবার বাড়িতে থেকে স্বামীর মৃত্যুর তিনদিন পর ১১ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলনে আসেন ইশরাত জাহান চৌধুরী।

সংবাদ সম্মেলনে কী বললেন ইশরাত
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ইশরাত বলেন, ‘আমার স্বামীর ফুফাত ভাই জাবেদ ইকবাল চৌধুরী, পারভেজ ইকবাল চৌধুরী ও সৈয়দ নাঈম উদ্দীন। এদের সাথে ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্যবসার সূত্রে ২৫ কোটি টাকা লেনদেন করেন আমার স্বামী।’

‘২০১৮ সাল পর্যন্ত এর বিপরিতে লভ্যাংশসহ তাদেরকে পরিশোধ করা হয় ৩৮ কোটি টাকা। কিন্তু তারা ২০১৮ সালের পর থেকে আরও টাকা দাবি করতে থাকে। এজন্য তারা ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিকভাবে আমার স্বামীকে প্রচণ্ড চাপ ও হুমকি ধামকি দিতে শুরু করে। ২০১৮ সালে আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় সৈয়দ সাকিব নাঈম উদ্দীন এর পাঁচলাইস্থ এমএম টাওয়ারে। সেখানে গিয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের পাসপোর্ট নিয়ে নেয়া হয়। তখন আমার স্বামীকে বেঁধে রেখে আরও ১২ কোটি টাকা অতিরিক্ত দাবি করে স্ট্যাম্পে জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেয়া হয়।’

ইশরাত বলেন, ‘এরপর হিলভিউর বাসায় এসে জাবেদ ইকবাল, পারভেজ ইকবালরা এসে হামলা করে। ব্যবসায় তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ সুদে আসলে ফেরত পাওয়ার পরও তারা টাকা দাবি করে আসছিল। তাদের নিকট থাকা জামানতের চেক ব্যবহার করে মামলা করেও তারা ক্ষান্ত হয়নি, উপর্যুপরি তার মেয়েকে অপহরণ ও মোরশেদকে খুন করবে বলে হুমকিও দিয়ে আসছিল।’

ইশরাত দাবি করেন, তাদের চাহিদামত টাকা না দেয়ায় প্রচণ্ড মানসিক চাপের শিকার হয়ে তার স্বামী আত্মহত্যা করেছে। এদের সাথে রয়েছে আরও কয়েকজন চিহ্নিত রাজনেতিক সন্ত্রাসী। যারা তাদেরকে মদদ দিয়েছে। তবে সংবাদ সম্মেলনে পাঁচলাইশ থানায় দায়েরকৃত মামলায় আসামি ছাড়া কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে তার স্বামীকে মানসিক ও শারিরীক নির্যাতনের অভিযোগ তুললেও কোন প্রমাণ তার কাছে নেই বলেও স্বীকার করেছেন ইশরাত জাহান।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, তার স্বামী মোরশেদ চৌধুরী মেধাবী ব্যাংকার ছিলেন। ১৬ বছর আগে তাদের বিয়ে হয়। একমাত্র কন্যা সন্তান মোজাশ্বেরা জুমকে নিয়ে ছিল তার সুখের সংসার। তার স্বামী সেই সুখের বন্ধনকে ছিন্ন করে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।

কী লেখা ছিল সুইসাইডাল নোটে
আত্মহত্যার আগে আবদুল মোরশেদ চৌধুরী লিখে যান সুইসাইডাল নোট। যেখানে তিনি আর চাপ নিতে পারছেন না বলে উল্লেখ করেন। সেই নোটের কিছু অংশ হচ্ছে- ‘আমি আর পারছি না-সত্য আর নিতে পারছি না, প্রতিদিন একবার করে মরছি…কিছু লোকের অমানবিক প্রেসার আর আমি নিতে পারছি না। প্লিজ সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আমার জুমকে সবাই দেখে রেখ।’

মোরশেদের পারিবারিক ঘনিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইশরাত জাহানের সাথে মোরশেদ চৌধুরীর বনিবনা ছিল না। ইশরাত জাহানের বাড়ি সিরাজগঞ্জে। চট্টগ্রামের কালচার ও শশুড়বাড়ির যৌথ পরিবারকে মানিয়ে নিতে পারছিল না ইশরাত জাহান। স্বামীর সাথে ঝগড়া করে আড়াই মাস আগে ইশরাত জাহান বাবার বাড়িতে থিতু হন। সংবাদ সম্মেলনে মোরশেদ মা নূর নাহার উপস্থিত থাকলেও তাকে কিছু বলতে দেয়া হয়নি।

মামলা তদন্তে, কোনো গ্রেপ্তার নেই
পাঁচলাইশ থানার ওসি (তদন্ত) মো. কবিরুল ইসলাম বলেন, ‘মামলা তদন্তাধীন আছে। আসামিদের কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। আমরা খোঁজ রাখছি। আমরা এখন পর্যন্ত যে তথ্য পেয়েছি, তাতে লেনদেনের বিষয়টিই রয়েছে।’

আইএমই/কেএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!