চট্টগ্রামে বেপরোয়া এক সিগারেট কোম্পানি, ১৫ বছর ধরে বেআইনি ব্যবসা

বশ মানছে না জরিমানা-মামলা-সিলগালায়ও

কাউকে তারা পরোয়া করে না। জরিমানা-মামলা কিছুই তাদের থামাতে পারছে না। ১৫ বছর ধরে অবৈধভাবে সিগারেট উৎপাদন করে তো যাচ্ছেই, ফাঁকি দিচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকার ভ্যাট-শুল্কও। বারবার তাগাদা ও জরিমানার পরও এমনকি এই প্রতিষ্ঠান পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়ারই গরজ বোধ করেনি। শুধু কি তাই, তিন বছর আগে ৬২ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিতে তৈরি করা হয় ভুয়া কোম্পানিও।

সিগারেট উৎপাদনকারী বেপরোয়া এই প্রতিষ্ঠানটির নাম ইন্টারন্যাশনাল টোবাকো ইন্ডাস্ট্রিজ। চট্টগ্রামভিত্তিক জামিল গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এটি।

গত বছরও পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই সিগারেট উৎপাদনের কাজ চালানোয় ইন্টারন্যাশনাল টোবাকো ইন্ডাস্ট্রিজকে ৭০ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বরের সেই ঘটনার এক বছর পর এবার কোম্পানিটিই সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। অপরাধ সেই একই— পরিবেশের ছাড়পত্র নেওয়ার তোয়াক্কা না করেই ব্যবসা করে যাচ্ছিল প্রতিষ্ঠানটি। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানটি নকল ট্যাক্স ও স্ট্যাম্প ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট উৎপাদনও করছে। গত সেপ্টেম্বরেই ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কিন্তু বরাবরের মতোই তারা বেপরোয়া।

চট্টগ্রামে বেপরোয়া এক সিগারেট কোম্পানি, ১৫ বছর ধরে বেআইনি ব্যবসা 1

সিলগালা এবার

সবশেষ গত বুধবার (১১ নভেম্বর) পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক নুরুল্লাহ নুরীর নেতৃত্বে এক অভিযানে নগরীর কালুরঘাট শিল্প এলাকায় প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগও।

জানা গেছে, পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়ে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষকে ৭০ লাখ টাকা পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ আরোপ করা হয়। একই আদেশে ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধ এবং ছাড়পত্র গ্রহণ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহানগর কার্যালয়ের এই আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে আপিল করলে সেখানে আপিল খারিজ হয়। কিন্তু পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণ ছাড়া উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রাখায় গত ১ জুলাই প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে শুনানিতে হাজির হবার নোটিশ দেওয়া হয়।

শুনানি শেষে পুনরায় প্রতিষ্ঠানটি আড়াই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ আরোপ করা হয়। ছাড়পত্র গ্রহণ ছাড়া উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সাথে পরিবেশগত ছাড়পত্রের জন্য অনলাইনে আবেদন করার এবং যে সমস্ত কাগজপত্র দাখিল করতে হবে তার তালিকাও দেওয়া হয়। কিন্তু এসবের কোনো তোয়াক্কা না করেই প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদন অব্যাহত রাখায় প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করে দেওয়া হয়।

টাকা ফাঁকি দিতে ভুয়া কোম্পানি

কাস্টমসের একটি তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রামভিত্তিক এই সিগারেট উৎপাদনকারী সংস্থা একটি ভুয়া কোম্পানি তৈরি করে ১৬৯ টন কাঁচামাল আমদানি করে ৬২ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টমসের অনুসন্ধানে জানা যায়, ইন্টারন্যাশনাল টোবাকো ইন্ডাস্ট্রিজ ২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে ‘বিপ্লব ট্রেডার্স’ নামের একটি ভুয়া কোম্পানির মাধ্যমে কাঁচামাল আমদানি করে।

তদন্তে দেখা গেছে, ইন্টারন্যাশনাল টোবাকো ইন্ডাস্ট্রিজ নিজেদের প্রতিষ্ঠানের মইন উদ্দিন সুহেল নামের এক কর্মকর্তার ব্যক্তিগত কাগজপত্র ব্যবহার করে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে ‘বিপ্লব ট্রেডার্স’ নামের ভুয়া কোম্পানিটি তৈরি করে। চট্টগ্রাম বন্দর ও ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ১৭ কনসাইনমেন্টে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের এসিটেট টো ও সিগারেট পেপার আমদানি করা হয় এই ভুয়া কোম্পানির মাধ্যমে। অথচ নাম ‘বিপ্লব ট্রেডার্স’ হলেও ব্যাংক একাউন্ট খোলা, এলসি এবং সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নিয়োগসহ সব কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল ইন্টারন্যাশনাল টোবাকো ইন্ডাস্ট্রিজই। এই সময়ের মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল টোবাকো ইন্ডাস্ট্রিজ ও এর পরিচালকদের অ্যাকাউন্ট থেকে বিপ্লব ট্রেডার্সের ব্যাংক একাউন্টে জমা পড়ে প্রায় ৬ কোটি টাকা।

চট্টগ্রামে বেপরোয়া এক সিগারেট কোম্পানি, ১৫ বছর ধরে বেআইনি ব্যবসা 2

ব্যাংকের ডকুমেন্ট থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, ইন্টারন্যাশনাল টোবাকো ইন্ডাস্ট্রিজের একাউন্ট থেকে ব্যাংক আল-ফালাহর আগ্রাবাদ শাখায় বিপ্লব ট্রেডার্সের অ্যাকাউন্টে প্রায় আড়াই কোটি টাকা ঢুকেছে। ২০১৭ সালের ২২ ও ২৩ জানুয়ারি এবং ৪ মে তিনটি চেকের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল টোবাকোর পরিচালক মোহাম্মদ আসফাকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে ৫৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা বিপ্লব ট্রেডার্সের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। এর বাইরেও ওই একাউন্টে কয়েকটি কিস্তিতে নগদে ঢুকেছে প্রায় এক কোটি টাকা।

এতো টাকার লেনদেন হলেও সরকার এইসব প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ভ্যাটই পায়নি। কারণ বিপ্লব ট্রেডার্স এবং ইন্টারন্যাশনাল তামাক কোম্পানির কোনো আইনগত অস্তিত্বই নেই। এসব ঘটনায় গত বছরের জুনে চট্টগ্রাম কাস্টমস ইন্টারন্যাশনাল টোবাকো ও বিপ্লব ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করে।

ভ্যাট ফাঁকি দেওয়াই স্বভাব যার

মাত্র এক মাসে নকল ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে সাড়ে ১৭ লাখ টাকা সরকারি ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর। গত ৮ সেপ্টেম্বর ঝটিকা পরিদর্শনে গিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় অবস্থিত ওই প্রতিষ্ঠানের কারখানা চত্বরে ৬০ কার্টন সিগারেটের সঙ্গে ব্যান্ডরোল বাঁধা অবস্থায় দেখতে পান। এতে তাদের সন্দেহ হয়।

ভ্যাট আইন অনুযায়ী, প্রতিটি সিগারেটের প্যাকেটে সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসের সরবরাহ করা একটি নতুন ব্যান্ডরোল ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ভ্যাট গোয়েন্দারা দেখতে পান সিগারেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কারখানায় পুরনো ও ব্যবহৃত ব্যান্ডরোল ব্যবহার করা হয়েছে। এতে ১৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা শুল্ক ফাঁকির চেষ্টা করা হয়েছে। অবৈধভাবে ব্যবহার করায় ‘সাহারা’ ও ‘এক্সপ্রেস’ ব্র্যান্ডের ২৪ লাখ টাকা মূল্যের ৬ লাখ শলাকা সিগারেট বাজেয়াপ্ত করা হয়।

ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান জানান, ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো নকল ট্যাক্স ও স্ট্যাম্প ব্যবহার করে সাহারা, জাভা, গোল্ডেন হিল, এক্সপ্রেস, রমনা ব্ল্যাক ও উইলসন ব্র্যান্ডের সিগারেট উৎপাদন করছে।

জানা গেছে, এর আগেও সিগারেটের শুল্ক ফাঁকি দেওয়ায় চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষ এই প্রতিষ্ঠানটিকে কয়েক দফায় জরিমানা করে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!