চট্টগ্রামে বিপুল রোগী চোখ হারাচ্ছে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ছাড়া অপারেশনে

অলিগলির লাইসেন্সবিহীন হাসপাতালেই রোগীর সর্বনাশ

কামাল হোসেন দুই মাস আগে চোখের ব্যথা নিয়ে আসেন চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেড এলাকার চট্টগ্রাম সিটি আই হাসপাতালে। এর আগে তিনি একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করেন। তার মনে হচ্ছিল চোখের সামনে পোকার মতো কালো কালো কি যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরপর তিনি আর কিছুই দেখতে পারছেন না। পরে সিটি আই হাসপাতালের চিকিৎসকরা তার উপসর্গ শুনে ডান চোখে অস্ত্রোপচার করেন। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকার পরও তার চোখের অপারেশন হওয়ায় ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি হারান কামাল হোসেন। এরপর বাম চোখ নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলের চক্ষু বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন তিনি।

কামাল হোসেনের মতো অসংখ্য মানুষ এভাবে প্রায় প্রতিদিনই হারাচ্ছেন চোখের দৃষ্টিশক্তি। এর প্রধান কারণ ডায়াবেটিস এবং ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা লাইসেন্সবিহীন চক্ষু ক্লিনিক ও হাসপাতাল।

চক্ষু বিশেষজ্ঞরা জানান, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না এনে চোখের অপারেশন করায় অনেক চোখের রোগী দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলছেন। এর পেছনে রয়েছে চিকিৎসকের দক্ষতার অভাব এবং অবহেলাও। সেইসঙ্গে যন্ত্রপাতি সঠিকভাবে স্ট্রেরিলাইজ না করা, অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত স্যালাইন ড্রপের মান খারাপ হওয়ার কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চোখ। আর এসব ঘটনা অহরহ ঘটছে চট্টগ্রামের অলিগলিতে গড়ে ওঠা লাইসেন্সবিহীন চক্ষু ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোতে।

লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষ চোখ ক্ষতিগ্রস্ত করে রোগীরা ভিড় জমাচ্ছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে। এখানে গড়ে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২০ জন রোগী চোখের চিকিৎসা নিতে আসেন। যাদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ রোগীই অদক্ষ চিকিৎসকের অবহেলার শিকার।

চক্ষু বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, ডায়াবেটিসের কারণে চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি চলে গেলে তা ফেরানোর আর কোনো উপায় থাকে না। তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যেমন জরুরি, তেমনি রোগীদের উচিত ডায়াবেটিস চিকিৎসার পাশাপাশি নিয়মিত চোখ দেখানো। সাধারণত ডায়াবেটিসজনিত চোখের সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় যখন চোখের রেটিনা আক্রান্ত হয়। এতে রেটিনাতে যে সমস্যা হয়, তাকে বলা হয় ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি। রেটিনা হলো চোখের ভেতরের একটি অতি সংবেদনশীল পর্দা, যা আমাদের দৃষ্টির জন্য অপরিহার্য।

এখন ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বেশি। তাই প্রতি তিনজন রোগীর একজনের ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি দেখা দেয়। তবে প্রত্যেক রোগীই এ রোগের ঝুঁকিতে থাকেন। তাই এ রোগ প্রতিরোধ জরুরি। চোখের ভেতর রেটিনার রক্তপাত হওয়ার আগেই যদি প্রতিরোধ করা যায়, আক্রান্ত রক্তনালিগুলোর যদি সময়মতো চিকিৎসা করানো যায়, তাহলে অন্ধত্ব প্রতিরোধ সম্ভব। রেটিনোপ্যাথি হলে কালার ফান্ডাস ফটোগ্রাফি এবং ফ্লুরোসিন এনজিওগ্রাফি করে নেওয়া ভালো। এতে পরবর্তী সময় রেটিনার পরিবর্তন এবং রেটিনোপ্যাথির অবস্থা নির্ণয়ে সুবিধা হয়। এনজিওগ্রাফি ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির স্তরবিন্যাস, রক্তনালিকার পরিবর্তন, সম্ভাব্য চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ণয়েও সাহায্য করে।

জানা যায়, পৃথিবীতে যেসব কারণে অন্ধত্ব হয়, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি তার অন্যতম কারণ। যার যত বেশিদিন ধরে ডায়াবেটিস রয়েছে, তার রেটিনা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তত বেশি। প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগে চোখের রেটিনায় রক্তবাহী সরু ধমনিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে রক্তনালি ফুটো হয়ে রক্ত বের হয়ে আসে। দৃষ্টিশক্তি কমে যায় তখন। পরে ধমনিতে রক্ত চলাচলের সমস্যা আরও বাড়লে রেটিনার বিভিন্ন অংশে ঠিকমতো অক্সিজেন পৌঁছায় না। সেই অক্সিজেনের অভাব পূরণ করতে গজিয়ে ওঠে নতুন সরু রক্তনালি। কিন্তু তারা এতই ক্ষুদ্র ও অপরিপক্ক থাকে, অনেক চেষ্টা করেও রেটিনার নানা অংশে রক্ত পৌঁছাতে পারে না। ফলে নতুন এই দুর্বল নালিগুলো ফেটে গিয়ে চোখে রক্তক্ষরণ হয়। তখন চোখের সামনে পোকার মতো কালো দাগ দেখা দেয়। এরপর একসময় রেটিনা আলাদা হয়ে সরে যেতে পারে। তখন দৃষ্টিশক্তি একেবারেই চলে যায়।

চট্টগ্রামের প্রায় লাইসেন্সবিহীন অর্ধশতের বেশি অবৈধ চক্ষু হাসপাতাল রয়েছে। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি বেসরকারি চক্ষু হাসপাতাল ঘুরে দেখা মেলেনি চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের। রোগীর আস্থা অর্জন করতে এসব হাসপাতালে আবার ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বিদেশি ডিগ্রিধারী নামি-দামি চিকিৎসকের নাম। চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিপ্তরের অনুমোদন ব্যতীত চক্ষু হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে আগ্রাবাদ এলাকার চিটাগাং আই হাসপাতাল, বহদ্দারহাট বড়পুকুর পশ্চিম পাড়ের বহদ্দারহাট চক্ষু হাসপাতাল, দুই নম্বর মাইল এলাকার ন্যাশনাল চক্ষু হাসপাতাল, আগ্রাবাদ কমিউনিটি চক্ষু হাসপাতাল, পাঠানটুলী এলাকার এ্যাপোলো চক্ষু হাসপাতাল, কলেজবাজার রোডের কর্ণফুলী চক্ষু হাসপাতাল, আগ্রাবাদের সিগমা চক্ষু হাসপাতাল, ইপিজেড এলাকার চট্টগ্রাম সিটি আই হাসপাতাল এবং আগ্রাবাদ চৌমুহনীর ভিশন চক্ষু হাসপাতাল।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. মোহাম্মদুল হক মেজবাহ বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যতজন চোখের রোগী আছে, তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি রোগী আসেন চোখ হারিয়ে। এসব রোগীদের বেশিরভাগের ডায়বেটিস অনিয়ন্ত্রিত। তাই এসব রোগীদের চোখের ছানি, লেন্স কিংবা সাধারণ অপারেশন কিছু নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে সম্পন্ন করতে হয়। যার জন্য প্রয়োজন ইনডাইরেক্ট অফতালমস্কো, এওবি স্কেল, বায়োমেট্রিকসহ অত্যাধুনিক মেশিন। আর অবশ্যই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করেই অপারেশনে যেতে হবে চিকিৎসকদের।’

সরেজমিন চট্টগ্রাম মেডিকেলের চক্ষু বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সঙ্গে কথা বলে ডাক্তারের কথার সত্যতা পাওয়া যায়।

চক্ষু বিভাগে চিকিৎসা নিতে অপেক্ষমাণ আলেয়া বেগম জানান, তার চোখ দিয়ে সবসময় পানি ঝরত। মাঝে মাঝে ব্যথা লাগত। তার বাড়ি কাপ্তাই রাস্তার মাথায়। পাশের বাড়ির চাচাত দেবর চাকরি করেন কাপ্তাই রাস্তার মাথায় ভিশন কমিউনিটি চক্ষু হাসপাতালে। তার কথামতো সেখানে গেলে তাকে ১২ হাজার টাকায় চোখের অপারেশন করানো হয় ২০১৯ সালের নভেম্বরে। তাকে জানানো হয়, ডায়াবেটিস থাকার কারণে যত্ন নিয়ে অপারেশন করতে হবে। এজন্য আরও দেড় হাজার টাকা বেশি নেওয়া হয়। কিন্তু অপারেশনের পর তার চোখ আরও খারাপ হয়। চোখের কোনায় ঘা দেখা দেয়। এভাবে তার আরও দুই বছর কেটে যায়। তারপর তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেলে আসেন চোখের ডাক্তার দেখাতে।

আলেয়া বেগমের ভাই রউফ বলেন, ‘ডাক্তার জানিয়েছেন আমার বোনের চোখ আর ভালো হবে না। ধীরে ধীরে আমার বোন অন্ধ হয়ে যাবে।’

আলেয়া বেগমের কথার সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাপ্তাই রাস্তার মাথায় ভিশন কমিউনিটি চক্ষু হাসপাতাল পরিচালনায় পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে কোনো লাইসেন্স নেয়নি। কয়েকটি পুরনো ভবনের মাঝখানের একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় এটি নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে ডা. হায়াত নামে যিনি আছেন তিনি পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালের এক ডাক্তারের এটেনটেন্ড ছিলেন।

অথচ বেসরকারি হাসপাতাল পরিচালনার বিষয়ে ১৯৮২ সালের ‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস রেগুলেশন (অর্ডিনেন্স)’ নীতিমালায় উল্লেখ আছে, প্রাইভেট হাসপাতালের ক্ষেত্রে ১০ শয্যার হাসপাতাল পরিচালনার জন্য তিনজন এমবিবিএস ডাক্তার, ছয়জন ডিপ্লোমা নার্স, ছয়জন আয়া ও তিনজন সুইপার থাকতে হবে।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!