চট্টগ্রামে বাড়ছে গর্ভকালীন খিঁচুনি রোগী, চিকিৎসার বদলে ছুটেন কবিরাজের কাছে

মায়ের খিঁচুনিতে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে বাচ্চার

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন তোহরা বেগম। এর আগে গর্ভাবস্থায় তিনি একদিন দুপুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। আগে থেকেই তার উচ্চ রক্তচাপ ছিল। জ্ঞান ফিরে দেখেন মেডিকেলে ভর্তি। পরে তিনি জানতে পারেন, তার খিঁচুনি এসেছিল। মেডিকেলে ভর্তির পর আট মাসের গর্ভাবস্থায় তার সিজারিয়ান অপারেশন করা হয়। ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তিনি। বাচ্চাকেও রাখা হয়েছে নবজাতক ওয়ার্ডে। তবে তার শারীরিক জটিলতা এখনও কাটেনি।

চট্টগ্রাম মেডিকেলে তোহরার মতো প্রায়ই অর্ধশত গর্ভবতী নারী ভর্তি হয়েছে কয়েক মাসে। গর্ভবতী নারীদের এই জটিলতাকে মেডিকেলের ভাষায় বলা হয় প্রি-একলাম্পসিয়া বা প্রাক-গর্ভকালীন খিঁচুনি।

বিশেষজ্ঞ গাইনি ডাক্তাররা বলছেন, প্রি-একলাম্পসিয়াকে জ্বীন-ভূতের আছর মনে করেন অনেকে। এই সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে না নিয়ে বৈদ্য, কবিরাজের কাছে নিয়ে যান রোগীর স্বজনরা। আর এতেই রোগীর অবস্থা খারাপ হয়। অনেক সময় নবজাতককেও বাঁচানো যায় না।

তোহরার মতো একই সমস্যা রেবেকা বেগমের। তবে তার বাচ্চা বাঁচানো যায়নি। কাঁদতে কাঁদতে তিনি জানান, তার স্বামী প্রবাসী। শাশুড়ি আর দেবরের সঙ্গে থাকেন, বড় ননদও থাকেন সঙ্গে। গর্ভধারনের শুরু থেকেই তার উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও শহরে এনে ভালো ডাক্তার দেখায়নি শ্বশুড়বাড়ির লোকজন।

রেবেকা আরও জানান, মাঝে মাঝেই তার সন্ধ্যার পর মাথা ঝিমঝিম করতো। চোখে অন্ধকার দেখত। তখন শাশুড়ি বলতো, বাতাস লেগেছে। বাড়ির পাশের এক হুজুরের কাছ থেকে পানিপড়া এনে খাইয়েছিলেন, তাবিজও পরিয়েছিলেন।

সরেজমিন ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, ওয়ার্ডে ৫টি এসির মধ্যে মাত্র ১টি সচল রয়েছে। ১০টি বেডের এই ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি প্রায় অর্ধ শতাধিকের কাছাকাছি। বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) চিকিৎসাধীন একলাম্পসিয়া রোগী ছিল ৩২ জন। লেবার রুমের পাশে অন্ধকার এই রুমে রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খান ডাক্তাররা। প্রসব ব্যথায় মায়েদের চিৎকারে এসব রোগীদের চিকিৎসাসেবা সংকাটাপন্ন হয়ে পড়ে।

বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ বেড়ে যাওয়াকে অতিরিক্ত মানসিক চাপজনিত (হাইপারটেনসিভ) অসঙ্গতি বলা হয়। গর্ভকালীন মায়ের প্রাক-গর্ভকালীন খিঁচুনি নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি পাঁচ গুণ বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে অনেক সময় হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান রোগী। ২০ সপ্তাহ বা এরচেয়ে বেশি গর্ভাবস্থায় (মোট গর্ভকাল ৩৭ সপ্তাহ অধিক) অথবা সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় বা পরের দিনে কমপক্ষে চার ঘণ্টা যদি মায়ের রক্তচাপ ১৪০/৯০ থাকে, তবে সেই অবস্থাকে গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ বলে।

গর্ভাবস্থায় ল্যাবে প্রস্রাব পরীক্ষার সময় এলবুমিন বা প্রোটিনের উপস্থিতি থাকলে ওই মায়ের অতিরিক্ত রক্তচাপ আছে, এমনটি নির্দেশ করে। যদি এটি রক্তচাপ ও হৃদরোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে, তবে তাকে একলাম্পসিয়া বা গর্ভকালীন খিঁচুনি বলে। গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত রক্তচাপ দেহের বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত সরবরাহ অনেক কমিয়ে ফেলে যা মূত্রগ্রন্থি (কিডনি), হৃদযন্ত্র, যকৃৎ, মস্তিস্ক এবং জরায়ুর গুরুতর ক্ষতি করে। গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত রক্তচাপ মায়ের শরীর থেকে শিশুর শরীরে রক্ত সঞ্চালনে বাধা দেয়, যা স্বাভাবিকভাবে মায়ের পেটে শিশুর বেড়ে ওঠা ব্যাহত করে। এর ফলে অপরিণত ও কম ওজনের শিশুর জন্ম হয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের গাইনি ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান ডা. সাহেনা আক্তার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘হঠাৎ প্রাক-গর্ভকালীন খিঁচুনিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। চিকিৎসাসেবা উন্নতির পরও কেন একজন হবু মা এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, সেটি আমাদের ভাবাচ্ছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে আমরা যেটি পাচ্ছি সেটি হলো, গর্ভাবস্থায় সঠিক চিকিৎসা ও পরিচর্যার অভাব। এখনও গ্রামের মানুষ গর্ভাবস্থায় হবু মায়ের সমস্যাকে জ্বীন-পরীর আছর মনে করেন, যা দুঃখজনক।’

ডা. সাহেনা আক্তার রোগ প্রতিরোধের উপায় হিসেবে বলেন, ‘নিয়মিত আ্যান্টিনেটাল চেকআপে যেতে হবে। গর্ভকালীন পরিচর্যা, নিয়মিত রক্তচাপ মাপা, রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ, হাতে-পায়ে পানি এসেছে কি-না, প্রস্রাবে পানি এসেছে কি-না খেয়াল রাখতে হবে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!