চট্টগ্রামে ‘বধূ’ হয়ে এসএসসির ১৩ হাজার ছাত্রী ঝরে পড়েছে করোনার ঝড়ে

৭ হাজার ছেলে স্কুল ছেড়েছে এসএসসি না দিয়েই

দশম শ্রেণির ছাত্রী লিজা পড়তেন চট্টগ্রাম নগরীর পোস্তারপাড় সিটি করপোরেশন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। করোনাকালে স্কুলে যখন লাগাতার ছুটি চলছে, চলতি বছরের সেই মার্চে ফুফাতো ভাইয়ের সঙ্গে পারিবারিক সিদ্ধান্তে তার বিয়ে হয়ে যায় হঠাৎ সিদ্ধান্তে। আবুধাবীপ্রবাসী ফুফাতো ভাই বিয়ে সেরে এপ্রিলেই আবার প্রবাসজীবনে ফিরে যান। তবে যাওয়ার আগে লিজাকে পড়াশোনা বন্ধের কড়া নির্দেশ দিয়ে যান তিনি। ফলে নবম শ্রেণিতে এসএসসির জন্য রেজিস্ট্রেশন করেও পরীক্ষার আগে আর ফরম ফিলআপ করতে পারলেন না লিজা। এক ঝটকায় ভেঙে গেল এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন। পড়ার টেবিল ভর্তি অ্যাসাইনমেন্ট, নোটবই, খাতা— সবই পড়ে রইল। নগরীর ডবলমুরিংয়ের মনসুরাবাদে লিজার বাবার বাড়ি। স্বামী প্রবাসে থাকলেও লিজাকে চলে যেতে হল রাঙ্গুনিয়ার শ্বশুরবাড়িতে।

লিজা একা নন, করোনাকালে দীর্ঘ দেড় বছরেরও বেশি সময় স্কুল ছুটি চলাকালে নবম ও দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া অনেক মেয়ে শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে শিক্ষার্থীদের অনেকেই অভাবের তাড়নায় পড়াশোনা ছেড়ে সংসারের হাল ধরতে আয়-রোজগারে ঝুঁকেছেন। চট্টগ্রামে পরিসংখ্যানের অংকে ঝরে পড়া এরকম শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৯ হাজার ৭৩৬ জন।

চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের আওতায় দুই বছর আগে নবম শ্রেণিতে ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৮১১ জন। এর মধ্যে ছাত্র ৬৭ হাজার ৯৮২ জন ও ছাত্রী ৮৫ হাজার ৬৯৫ জন।

২০২১ সালের জুলাই-আগস্টে এসে ফরম ফিলআপ করেছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৭৫ জন। অনিয়মিত পরীক্ষার্থী হিসেবে ফরম ফিলআপ করেছে ২৬ হাজার ৭৭৫ জন।

নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করা নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবং ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ফরম ফিলআপ করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় দেখা গেছে, চট্টগ্রামে করোনাকালেই ঝরে যাওয়া এসএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৯ হাজার ৭৩৬ জন। এর মধ্যে ছেলে ৬ হাজার ৮৯৩ জন এবং মেয়ে ১২ হাজার ৮৪৩ জন।

নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করে এসএসসিতে ফরম ফিলআপ না করার পেছনে শিক্ষা কর্মকর্তারা দায়ী করছেন করোনাকালীন দীর্ঘ ছুটিকে। তারা বলছেন, করোনাকালের এ সময় অনেক ছেলে শিক্ষার্থী আয়-রোজগারের আশায় শহরে চলে এসে গার্মেন্টসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজ নিয়েছে। অনেকেই অন্য ছোটখাটো কাজেও জড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা।

চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাকালে অভাবের সংসারে ছেলে শিক্ষার্থীদের অনেককেই ধরতে হয়েছে পরিবারের হাল। আর এটি করতে গিয়ে উচ্চশিক্ষার প্রতি তাদের মধ্যে জন্মেছে অনাগ্রহ। অনেক ছেলে আবার বাড়িতেই কৃষিকাজ করছে।

অন্যদিকে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ফরম ফিলআপ না করার পেছনে শিক্ষকরা মূল যে কারণটি দেখতে পেয়েছেন— সেটি হল বিয়ে। করোনাকালের এ সময়টায় আগে ও পরে অনেক প্রবাসী ছেলে দেশে এসেছেন। যেহেতু এসএসসি পরীক্ষার্থী, তাই পাত্রপক্ষের পছন্দের তালিকায় চলে আসে এই ছাত্রীরা। বিশেষ করে পারিবারিক চাপে হুট করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে ফরম ফিলআপ করতে না পারা অনেক ছাত্রীকে।

চন্দনাইশ উপজেলার ধোপছড়ি শিলঘাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ ইসহাক বলেন, ‘আমার স্কুলে নবম শ্রেণিতে ২৫৮ জন পরীক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন করেছিল। কিন্তু এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ফরম ফিলআপ করেছে মাত্র ১০০ জন। শিক্ষার্থীদের ফরম ফিলআপে অংশ নিতে আমি এলাকায় মাইকিংও করেছি। মন্দিরে পুরোহিতকে বলেছি অভিভাবকদের বলতে। তারপরও সাড়া মেলেনি। আমার কাছে খবর এসেছে স্থানীয় প্রবাসী ছেলেদের সাথে অনেক এসএসসি পরীক্ষার্থী ছাত্রীকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। করোনার শুরু থেকে যে মেয়েটি নিয়মিত আসাইনমেন্ট জমা দিয়ে আসছিল, সেই মেয়েটি পরীক্ষার আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসায় আর ফরম ফিলআপটা করতে পারল না। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির নির্দেশ আসে পড়াশোনা না করার। বিষয়টি আমাদের মনোবলকে ভেঙে দিয়েছে।’

হতাশার এমন সুর শোনা গেছে চট্টগ্রামের আরও বিভিন্ন উপজেলার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান ও সহকারী শিক্ষকদের কণ্ঠে। তারা বলেছেন, করোনাভাইরাসে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এ সময় ছাত্রীদের বিয়ের সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গ্রামীণ পরিবারগুলোতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে।

তারা বলেন, বিভিন্ন দেশে কর্মরত অভিবাসী শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিরা এ সময়টায় দেশে ফিরেছেন। সমাজ বাস্তবতায় ‘পাত্র’ হিসেবে প্রবাসী ছেলেদের চাহিদা বেশি। আর এই অবরুদ্ধ অবস্থায় হাতের কাছে ‘যোগ্য পাত্র’ পেয়ে নবম-দশম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েদের বিয়ে দিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছেন অনেক অভিভাবকই।

শিক্ষকদের অনেকে এও বলেছেন, অপরিণত বয়সে বিয়ে নিয়ে প্রশাসনের নজরদারিও এখন তুলনামূলক কম হচ্ছে। সেই সুযোগও কাজে লাগাচ্ছেন কেউ কেউ। সমাজের দরিদ্র অনেক অভিভাবকই এ সময় মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফেলতে আগ্রহী। এ সময়টায় স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গের ভয়ে খুব বেশি মানুষকে আপ্যায়ন করতে হচ্ছে না। এতে তাদের খরচও কমে যাচ্ছে।

বান্দরবান বালাঘাটা বিলকিছ বেগম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিশুদ্ধানন্দ বড়ুয়া জানান, তার স্কুলে মোট ১১৭ জন শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন করেছিল এসএসসির জন্য। ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ফরম ফিলআপ করেছে ১০৫ জন। যারা ফরম ফিলআপ করেনি, তাদের ১২ জনই ছাত্রী। তাদের সবারই বিয়ে হয়ে গেছে এই করোনার এই সময়টাতে।

সারা বছর পড়ানোর পরও শিক্ষার্থীদের এমন আকস্মিক ঝরে পড়া নিয়ে হতাশ এই শিক্ষক বলেন, ‘বান্দরবানের মত পাহাড়ি এলাকায় আমরা চেষ্টা করেছি শিক্ষার্থীদের এসএসসি পর্যন্ত ধরে রাখতে। অভিভাবকদের বুঝিয়েছি। কিন্তু করোনালীন এই ছুটিতে প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে ছাত্রীদের খোঁজ রাখা সম্ভব হয়নি। কিন্তু আমরা চাই আমাদের প্রত্যেকটা শিক্ষার্থী পরীক্ষার হলে বসে পরীক্ষা দিক।’

চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের প্রধান স্কুল পরিদর্শক ড. বিপ্লব গাঙ্গুলী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনার এই ধাক্কায় মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার লাগাম টানা গেল না। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ সরকার শিক্ষার পেছনে যথেষ্ট পরিমাণে বিনিয়োগ করছে। শিক্ষকদের বেতন বাড়ল। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হল। তারপরও এসএসসির আগে শিক্ষার্থীদের এই ঝরে পড়া খুবই কষ্টদায়ক।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!