চট্টগ্রামে ফ্যামিলি কার্ড পাচ্ছে তিন লাখ পরিবার, গরিবদের বড় অংশই বঞ্চিত

রমজানকে সামনে রেখে রোববার (২০ মার্চ) থেকে চট্টগ্রামের প্রায় তিন লাখ পরিবার রোজার আগে ও রোজার মধ্যে দুই দফা কম দামে পাবে টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। কিন্তু সরকারের এই বিশেষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চট্টগ্রামের নিম্ন আয়ের বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ভোটার না হলে মিলছে না টিসিবির ‘ফ্যামিলি কার্ড’। ফ্যামিলি কার্ডের আওতায় না আসলে টিসিবির পণ্য নেওয়া যাবে না। যার ফলে নিম্ন আয়ের ও ভাসমান মানুষ সরকারের এই বিশেষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

‘ফ্যামিলি কার্ড’ কর্মসূচির আওতায় চট্টগ্রামের প্রায় তিন লাখ পরিবারের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এই ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে একসঙ্গে পাঁচ পণ্যের প্যাকেট পাবেন কার্ডধারীরা। প্রতি প্যাকেটে থাকবে দুই লিটার ভোজ্যতেল, দুই কেজি চিনি, দুই কেজি ছোলা, দুই কেজি মসুর ডাল ও পাঁচ কেজি পেঁয়াজ। সেখানে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১১০ টাকা, প্রতি কেজি চিনি ৫৫, মসুর ডাল ৬৫, পেঁয়াজ ৩০ টাকা। ছোলার দাম এখনও নির্ধারণ হয়নি।

জানা গেছে, চট্টগ্রামের বিভিন্ন কারখানায় কাজ করা অধিকাংশ শ্রমিক সিটি কর্পোরেশন এলাকার ভোটার নয়। নতুন নিয়মের ফলে নিম্নআয়ের বৃহৎ এই জনগোষ্ঠী পাবে না সুবিধা। ২০১১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায়, চট্টগ্রাম শহরে ভাসমান লোকের সংখ্যা ১৫ লাখ। তারাও টিসিবির পণ্য কিনতে পারবে না। যদিও সংশ্লিষ্টদের হিসাব মতে, ভাসমান লোকের সংখ্যা সরকারি হিসেবের দ্বিগুণ হবে বর্তমানে।

এছাড়া বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কম বেতনের চাকরিজীবীরা খরচ কমাতে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ‘ব্যাচেলর বাসা’য় থাকেন। নতুন নিয়মের ফলে কপাল পুড়েছে তাদেরও।

সিটি কর্পোরেশন এলাকায় নিম্ন আয়ের বড় এই জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ টিসিবির সেবাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকার এই বিশেষ সুবিধা দিলেও সেটির সুষ্ঠু বণ্টন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

আগে যে কেউ লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবির পণ্য কিনতে পারতেন। দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক উর্ধগতির কারণে নিম্নআয়ের ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবির পণ্য কিনতে দেখা গেছে। এখন ফ্যামিলি কার্ডের নিয়ম চালু হওয়ায় কার্ডধারী ছাড়া অন্য কেউ পণ্য কিনতে পারবে না।

নগরীর আতুরার ডিপো এলাকায় ২০ বছর ধরে বসবাস করেন আকতার আহমেদ। সিটি কর্পোরেশনে তার পরিবারে কেউ ভোটার নন। আকতার বললেন, ‘সাশ্রয়ের জন্য অনেক সময় টিসিবির পণ্য কিনতে পারতাম। এখন তো আর কিনতে পারবো না।’

চট্টগ্রামের বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তালিকায় একই পরিবারের একাধিক সদস্য, কাউন্সিলরদের আত্মীয়-স্বজন, স্বচ্ছল ও সরকারি সুবিধাভোগী লোকজনদের উপকারভোগীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দলীয় অনুগতদের দেওয়া হচ্ছে ফ্যামিলি কার্ড—এমন অভিযোগও উঠেছে। অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে তালিকায় উপকারভোগী হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য সরকারি নির্দেশনা থাকলেও সেটি মানা হচ্ছে না।

জানা গেছে, জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে এই ফ্যামিলি কার্ড বিরতণ করা হচ্ছে। আর তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলরদের মাধ্যমে।

এ বিষয়ে একাধিক কাউন্সিলরের সাথে কথা হয় চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সাথে। তালিকা প্রস্তুতে অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেছেন এই কাউন্সিলররা। সিটি কর্পোরেশনের ভোটারের বাইরে তেমন কাউকে ফ্যামিলি কার্ডের আওতায় আনা হচ্ছে না বলেও জানান তারা।

১৭নং পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ শহিদুল আলম বলেন, ‘তালিকা প্রস্তুতে অনিয়ম হয়নি। ওয়ার্ডের ভোটার হলে যাচাই বাচাই করে কার্ড দেওয়া হচ্ছে। ভোটারের বাইরে কার্ড দেবো কিভাবে? তারা যে এখানের সেটি নিশ্চিত হবো কিভাবে? তবুও যারা দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় বসবাস করছে তাদেরকে দেওয়া হয়েছে। তবে এর সংখ্যা খুব কম।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) চট্টগ্রাম আঞ্চলিক প্রধান জামাল উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ফ্যামিলি কার্ডের তালিকা জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে হয়েছে। আমরা শুধু পণ্য সরবরাহ করব। কার্ডের বাইরে আমরা কাউকে পণ্য দেবো না।’

টিসিবি জানিয়েছে, রমজানকে সামনে রেখে ২০ মার্চ থেকে চট্টগ্রামের প্রায় তিন লাখ পরিবার পাবে টিসিবির পণ্য। ‘ফ্যামিলি কার্ড’ কর্মসূচির আওতায় চট্টগ্রামের প্রায় তিন লাখ পরিবারের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে করোনাকালে প্রধানমন্ত্রীর নগদ অর্থ সহায়তা পেয়েছেন, তাদের সবাই পাচ্ছেন ‘ফ্যামিলি কার্ড’।

সূত্র জানায়, ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে একসঙ্গে পাঁচ পণ্যের প্যাকেট পাবেন কার্ডধারীরা। প্রতি প্যাকেটে থাকবে দুই লিটার ভোজ্যতেল, দুই কেজি চিনি, দুই কেজি ছোলা, দুই কেজি মসুর ডাল ও পাঁচ কেজি পেঁয়াজ। সেখানে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১১০ টাকা, প্রতি কেজি চিনি ৫৫, মসুর ডাল ৬৫, পেঁয়াজ ৩০ টাকা। ছোলার দাম এখনও নির্ধারণ হয়নি।

জানা গেছে, একজন কার্ডধারী রোজার আগে এবং রোজার মধ্যে দুই দফা পণ্য পাবেন। প্রথম কিস্তির পণ্য পাবেন ২০ মার্চ থেকে। দ্বিতীয় কিস্তির পণ্য দেয়া হবে রোজার মাঝামাঝি সময়ে।

এই কর্মসূচির জন্য সারা দেশে দুই কোটি লিটার সয়াবিন তেল, ৪০ হাজার মেট্রিক টন চিনি, ৪০ হাজার মেট্রিক টন মসুর ডাল ও ৪০ হাজার মেট্রিক টন ছোলা এবং ২৫ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ প্রয়োজন হবে।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘অপব্যবহার করা না হলে এটি অবশ্যই ভালো একটি উদ্যোগ। তবে কার্ড বণ্টনের কাজটি অবশ্যই ভালোভাবে করতে হবে। যারা কর্মকর্তা আছেন বা রাজনৈতিক নেতা আছেন শুধু তাদের আত্মীয়-স্বজন কার্ড পেলে এর যথাযথ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে না। কোনো ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম যেন না হয় সেই বিষয়টি নজরে রাখতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এক কোটি পরিবার কার্ড পাবে মানে ৪ থেকে ৫ কোটি লোক এই সুবিধার আওতায় আসবেন। যেহেতু সামনে রমজান মাস, তাই রমজানে মাসে যেসব পণ্য বেশি ব্যবহৃত হয় সেগুলোই যেনো দেওয়া হয়।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!