চট্টগ্রামে প্রতি মাসে ১২ জনের অধিক শিশুর মৃত্যু হচ্ছে পানিতে ডুবে

৩০ মার্চ, মঙ্গলবার দুপুরের পর পর বাড়ির সবাই যখন নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত তখন দেড় বছরের শিশু সামাদ খেলতে গিয়ে পড়ে যায় পুকুরে। ১৫ থেকে ২০ মিনিট খোঁজাখুঁজির পর স্বজনরা তাকে পুকুরে দেখতে পায়। পরে পুকুর থেকে তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার পূর্ব গুজরার আঁধারমানিকের রওশন তালুকদারের বাড়ির সামাদের এই ঘটনায় শুধু নয়, প্রতি মাসেই গড়ে ১২ জনের অধিক শিশু পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে চট্টগ্রামে। মারা যাওয়া শিশুদের বেশিরভাগেরই বয়স দেড় বছর থেকে ৭ বছরের মধ্যে। গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৩১ মার্চ এই ১৫ মাসে চট্টগ্রামে পুকুরে ডুবে শিশু মারা যায় ১৮৪ জন।

পানিতে ডুবে একই পরিবার থেকে একাধিক সন্তানও মারা গেছে। বেশিরভাগ নানার বাড়ি, দাদার বাড়ি কিংবা শহর থেকে গ্রামে কোন আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে। আর গ্রামের যেসব বাচ্চারা পানিতে ডুবে মারা গেছে তাদের বেশিরভাগই মা রান্না ঘরে ব্যস্ত ছিল। শিশুটি উঠানে একা একা খেলা করছিল। খেলার এক ফাঁকে সবার অজান্তে পুকুর ধারের কাছে গিয়ে পুকুরে পড়ে পানিতে তলিয়ে যায। পরিবারের যখন টনক নড়ে বাচ্চা কোথায়, তখন অনেক দেরী হয়ে যায়। বাচ্চাকে যখন পাওয়া যায় তখন পুকুরের পানিতে লাশ হয়ে ভাসছে সেই আদরের সন্তান।

এদিকে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন অভিভাবকদের সচেতন না হওয়াই এসব মৃত্যুর প্রধান কারন। চট্টগ্রামের উপজেলা গ্রামগুলোতে বেশিরভাগ প্রবাসী স্ত্রীদের বেশিরভাগ সময় মোবাইলে কথা বলায় ব্যস্ত থাকায় পানিতে পড়ে শিশু মৃত্যুর এ দুর্ঘটনা বেশি ঘটে বলে মনে করছেন স্থানীয় সংশ্লিষ্ট অনেক ব্যক্তি। আবার সাঁতার না জানাও একটা বড় কারন বলে মনে করেন কেউ কেউ। গ্রামের মুরুব্বী শ্রেণির অনেকের অভিমত, অতীতে গ্রামের ৫ থেকে ৬ বছরের শিশুরা সাঁতার কাটা শিখে যেত। এখন ১০ পেরিয়ে গেলেও শিশুরা পানিতে নামতে ভয় পায়।

সম্প্রতি গণমাধ্যম ও যোগাযোগবিষয়ক বেসরকারি সংগঠন ‘সমষ্টি’র এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত ১৫ মাসে সারা দেশে ৯৬৮ জন পানিতে ডুবে মারা গেছে। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৮০৮। মোট মৃত্যুর মধ্যে ১১৮ জন নৌ দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের পক্ষে গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এ বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে সংগঠনটির এসব তথ্য পাওয়া।

সমষ্টির প্রতিবেদন অনুসারে, গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এ বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত পানিতে ডুবে মারা যাওয়াদের মধ্যে ৮৩ শতাংশই শিশু। চার বছর বা কম বয়সী ৩৪৮ জন, ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী ৩০৮ জন, ৯ থেকে ১৪ বছরের ১২০ জন এবং ১৫ থেকে ১৮ বছরের ৩২ জন মারা গেছে। ১৬০ জনের বয়স ১৮ বছরের বেশি। মোট মৃত্যুর মধ্যে ৭৮৩ শিশুর মৃত্যু হয়েছে পারিবারিক অসতর্কতা বা শিশুদের প্রতি নজরদারি না থাকার কারণে। ওই শিশুরা বড়দের অগোচরে বাড়িসংলগ্ন পুকুর বা অন্য জলাশয়ে চলে গেলে দুর্ঘটনার শিকার হয়।

সমষ্টির প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৫ মাসে বন্যার পানিতে ডুবে ৫৫ জন, মৃগীরোগ ও জলাতঙ্ক থেকে পানিতে ডুবে ৬ জন, নদীতে ঝাঁপ দিয়ে বা খেলতে গিয়ে ৩ জন, অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে ১ জন এবং পানির ট্যাংকে ডুবে ২ জন নিহত হয়।

সমষ্টির পরিচালক মীর মাসরুর জামানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যর ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। চোখের সামনে করুণ মৃত্যু। বাবা মায়ের এ যন্ত্রনা যারা চোখের সামনে দেখে থাকে, তারাই জানে এর ভয়াবহতা। এক্ষেত্রে সবার সচেতনতা জরুরী। শিশুকে সাতার শেখানো সবচেয়ে বেশি জরুরী বলেন মীর মাসরুর জামান।’

সমষ্টির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ মাসে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ঢাকা বিভাগে (২১১ জন)। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ১৮৪ জন, রংপুরে ১৪৩, রাজশাহীতে ১২১, ময়মনসিংহে ১০৬, বরিশালে ৮৩ ও খুলনা বিভাগে ৭২ জন মারা গেছে। এ সময়ে সবচেয়ে কম মৃত্যু ছিল সিলেট বিভাগে, ৪৮ জন। সকালের দিকে সবচেয়ে বেশি ৩৯৪ জন এবং দুপুরে ৩৮৮ জন মারা গেছে। বাকিরা অন্য সময়ে মারা গেছে।

রাউজান উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান আব্বাস উদ্দিন আহমেদ জানান, ‘কিছুদিন পরপর পুকুরে ডুবে শিশু মৃত্যুর খবর পাই। ঘটনাস্থলে গিয়ে মৃত শিশুর মুখ দেখে চোখের পানি আটকানো যায় না। আমি গ্রামের সব সভা সমাবেশে অভিভাবকদের কোলের বাচ্চাকে নিরাপদে কাছে রাখার জন্য তাগাদা দেই। এরকম মৃত্যু দুঃখজনক।

চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক একটি নিউজ পোর্টালে কর্মরত একজন সহ-সম্পাদক সংবাদকর্মী তার অভিজ্ঞতার কথা বলেন এভাবে, ‘উপজেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো নিউজে কোন কোনদিন দুই থেকে তিন জনও শিশু মৃত্যুর খবর থাকে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। এমন দিন যায় সপ্তাহে তা ৫-এর ঘরেও যায়। নিউজগুলো সম্পাদনা করতে গিয়ে বুক ভারি হয়ে আসে। এরকম নিউজ সম্পাদনা খুব হৃদয়বিদারক হয়ে পড়ে আমাদের জন্য।

আইএমই/এমএহক

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!