হয়রানি পদে পদে/ চট্টগ্রামে পাসপোর্ট সেবায় মূল বাধা পুলিশ ভেরিফিকেশন

চট্টগ্রামে পাসপোর্ট সেবা সঠিক সময়ে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পুলিশ ভেরিফিকেশন (যাচাই) প্রক্রিয়া। সাধারণ মানুষ পাসপোর্ট বানাতে গিয়ে এ কারণেই মূলত হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ করেন পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা। পাসপোর্ট হাতে পেতে যে কয়েকটি ধাপ পার হতে হয়, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ হচ্ছে পুলিশ ভেরিফিকেশন। দুর্নীতি, ঘুষসহ নানা কারণে পুলিশ ভেরিফিকেশনের এই প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ বরাবরই। ভেরিফিকেশনের এই প্রক্রিয়ায় পাসপোর্ট সেবা গ্রহীতারা হয়রানির শিকার হন—এমন অভিযোগ গ্রাহকদের মুখে মুখে। পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারাও স্বীকার করছেন, পাসপোর্ট সেবায় মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পুলিশ ভেরিফিকেশন (যাচাই) প্রক্রিয়া।

চট্টগ্রামের মনসুরাবাদ বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের সূত্রমতে, পুলিশ ভেরিফিকেশনের কারণে এক বছরে পাসপোর্ট আটকে ছিল ১১৫০টি। এছাড়া গত ২০ মাসে পাসপোর্ট সংক্রান্ত অভিযোগ জমা পড়েছে নয়টি, যার ছয়টিই পুলিশ ভেরিফিকেশনজনিত।

পুলিশি যাচাইয়েই সময় লাগে বেশি
পাসপোর্ট তৈরি করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের হয়রানি হওয়ার পিছনে পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়াকে প্রধান সমস্যা বলে দাবি করছেন পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা। জানা যায়, ইমারজেন্সি (জরুরি) পাসপোর্টের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময়সীমা ৩ দিন এবং সাধারণ পাসপোর্টের ক্ষেত্রে ৮ দিন। আর পাসপোর্ট অফিসে ইমারজেন্সি পাসপোর্টের ক্ষেত্রে ৭ দিন এবং সাধারণ পাসপোর্টের ক্ষেত্রে ১৫ দিন থাকলেও পাসপোর্ট ইস্যু করতে কখনও কখনও ৬ মাসেরও বেশি সময় লেগে যায়। চলতি নিয়মে পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া একটি পাসপোর্টও ইস্যু করা হয় না। হয়রানি এড়াতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রেও দালালদের কাছে যেতে হয় গ্রাহকদের—এমনটাই দাবি ভুক্তভোগীদের। এর পাশাপাশি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা দ্বারা সত্যায়িতকরণ প্রক্রিয়ার ঝামেলার কারণে গ্রাহকেরা দালালদের কাছে যান বলে স্বীকার করেন পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা।

যেভাবে হয় তথ্য যাচাই
পাসপোর্টের আবেদনের পর পাসপোর্ট অফিসের প্রাথমিক কাজ শেষে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির তথ্য যাচাইয়ের জন্য সেই আবেদনটির কপি পাঠানো হয় মহানগরের ক্ষেত্রে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে (এসবি) এবং জেলার ক্ষেত্রে পুলিশ সুপার কার্যালয়ের বিশেষ শাখায়। সংশ্লিষ্ট শাখা কিংবা থানার একজন উপসহকারী পরিদর্শক (এএসআই), সহকারী পরিদর্শক (সাব ইন্সপেক্টর) কিংবা পরিদর্শককে (ইন্সপেক্টর) তদন্ত বা তথ্য যাচাইয়ের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদন্ত শেষে ওই কর্মকর্তা তার দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সেটি জমা দেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের পর সেই প্রতিবেদন (পুলিশ ভেরিফিকেশন) আবার ফেরত পাঠানো হয় পাসপোর্ট অফিসে। প্রতিবেদনটি ইতিবাচক (পজিটিভ) হলে পাসপোর্ট অফিস সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পাসপোর্ট দেওয়ার পরবর্তী পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করে থাকে। একেই বলে ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’।

টিআইবির গবেষণা: ‘ভেরিফিকেশন অপ্রয়োজনীয়’
প্রায় দুই বছর আগে এক গবেষণা প্রতিবেদনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পক্ষ থেকে বলা হয়, পাসপোর্টের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন নেই। এতে পাসপোর্টের সেবা গ্রহীতা নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে পাসপোর্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিধান বাতিলের সুপারিশ করা হয়। এর কারণ হিসেবে পুলিশের দুর্নীতি ও অনিয়মকে দায়ী করা হয়। সুপারিশে বলা হয়, পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিধান বাতিল করে সব নাগরিকের জন্য ‘বায়োমেট্রিক ডাটা ব্যাংক’ তৈরির পাশাপাশি স্মার্ট কার্ড তৈরি ও বিতরণ অবিলম্বে সম্পন্ন করতে হবে। অপরাধীদের তথ্য সংক্রান্ত ‘অপরাধী তথ্য ভাণ্ডার’ আধুনিক ও যুগোপযোগী করার পাশাপাশি এই তথ্য ভাণ্ডারের সঙ্গে পাসপোর্ট অফিস ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের সংযোগ স্থাপন করতে হবে।

পুলিশের মতে, সময় লাগা স্বাভাবিক
পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়া প্রসঙ্গে নগর বিশেষ শাখার উপ-কমিশনার মো. আব্দুল ওয়ারিশ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘দুয়েকটা ব্যতিক্রম হতে পারে। যেমন ধরুন, বর্তমান ঠিকানা আর স্থায়ী ঠিকানা একেকটা হলে একটু সময় লাগবেই স্বাভাবিক। তাই বলে সবগুলোতে না। উনারা (পাসপোর্ট অফিস) কখন আমাদের কাছে তথ্য দেন আর আমরা কখন তাদের কাছে পাঠাই তা তো রেকর্ডে আছেই।’

পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া পাসপোর্ট ইস্যু হয় না এ কথাকে সমর্থন করে উপকমিশনার বলেন, ‘অবশ্যই আমিও স্বীকার করি আমাদের ক্লিয়ারেন্স ছাড়া পাসপোর্ট ইস্যু হয় না।’ রোহিঙ্গারা এখন পাসপোর্ট নিয়ে বাইরের দেশে গিয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে—এমন প্রশ্নের জবাব তিনি বলেন, ‘যদি কোনো রোহিঙ্গা পাসপোর্ট পেয়ে থাকে তাহলে তা আমাদের ব্যর্থতা। তবে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।’

পাসপোর্ট বিলম্বে জনবলও দায়ী
পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়াও পাসপোর্ট সেবা বিলম্বিত হওয়ার পেছনে জনবল সংকটকে দায়ী করছেন কর্মকর্তারা। প্রয়োজন ২ হাজার ৫০০ লোকবল, সেক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাস হয়েছে ৯৭৭ জনের সংস্থান। ২৫ জনের কাজ ১১ জন দিয়ে করানো হয় বলে জনগণকে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে হিমশিম খায় বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস।

দালালের দৌরাত্ম্য নেই পাসপোর্ট অফিসে!
প্রতিদিন গড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ গ্রাহক পাসপোর্ট সেবা দিতে আসেন। নতুন পাসপোর্ট ইস্যু ও নবায়ন সংক্রান্ত গ্রাহক থাকেন প্রায় ৭০০ জন। পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে দালাল নেই এবং আশেপাশে ঘোরাঘুরি করলেও ভেতরে আসার সুযোগ তাদের নেই—এমনটিই বললেন বিভাগীয় উপপরিচালক আবু নোমান মো. জাকির হোসেন।

তবে গ্রাহকদের অনেকেরই এ ব্যাপারে ভিন্নমত। আবুধাবি প্রবাসী এক ভুক্তভোগী আবছার তৈয়বী পাসপোর্ট নবায়ন করতে গিয়ে হয়রানির ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম- আমার শ্রম ও কথা মিথ্যা প্রমাণিত হল আর দালালদের কথাই সত্য হল। কিন্তু ডিজিটাল পাসপোর্ট নবায়নের ক্ষেত্রে নতুন পাসপোর্টের মতো দীর্ঘসূত্রিতা, হয়রানী ও ঘুষ বাণিজ্য কবে নাগাদ বন্ধ হবে- কেউ কি বলতে পারেন?’
তিনি অভিনব পরামর্শ রেখে বলেন, ‘পাসপোর্ট ফরমে ভ্যাটের সাথে ঘুষ (দালাল ফি) সংযুক্ত করুন।’

মনসুরাবাদ বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে এক মতবিনিময় সভা
মনসুরাবাদ বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে এক মতবিনিময় সভা

পাসপোর্ট সেবা নিয়ে মতবিনিময়
সাধারণ মানুষ পাসপোর্ট বানাতে গিয়ে কেমন ধরনের হয়রানির শিকার হন এবং সরকারি দফতরে সেবার মান উন্নয়নে কেমন ভূমিকা থাকা উচিত তা নিয়ে সোমবার (১ জুলাই) বিকেলে মনসুরাবাদ বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। মতবিনিময় সভায় সমস্যাবলী তুলে ধরে পাসপোর্ট সেবাকে জনগণের কাছে আরও সহজভাবে পৌঁছে দিতে বিভিন্ন পরামর্শ দেন অংশগ্রহণকারীরা। সেই সাথে চট্টগ্রাম মহানগর দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ কমিটির নেতারা অনুরোধ জানান প্রবাসী ও বয়স্ক ব্যক্তিরা পাসপোর্ট করতে গিয়ে যাতে হয়রানির শিকার না হন সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে এবং পাশাপাশি সাধারণ মানুষ পাসপোর্ট তৈরি করতে গিয়ে কোথায়-কীভাবে হয়রানির শিকার হন তা জানতে গণশুনানি করতেও অনুরোধ করেন।

মতবিনিময় সভার বিশেষ অতিথি দুর্নীতি দমন কমিশন, সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এর উপ-পরিচালক মোহাম্মদ লুৎফুল কবির চন্দন বলেন, ‘আমাদের সেবা দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সরকার চায় সবক্ষেত্রে দুর্নীতি শূন্য হারে নেমে আসুক। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণও করতে হবে।’
সাধারণ জনগণকে দালালদের কাছে না গিয়ে প্রয়োজনে পাসপোর্ট অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতা নিতেও অনুরোধ জানান তিনি।

প্রধান অতিথি দুদক বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মো. আবদুল করিম বলেন, ‘সদিচ্ছার মানসিকতা না থাকলে সরকার থেকে যতই সেবা দেয়া হোক না তা কার্যকর হবে না। তাই মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।’

আবু নোমান মো. জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে ও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস পাঁচলাইশের উপ-পরিচালক মো. আল আমিন মৃধার সঞ্চালনায় সভায় উপস্থিত ছিলেন দুদকের সহকারী পরিচালক জাফর আহমেদ, দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ কমিটির সদস্য শাওন পান্থ প্রমুখ।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!