চট্টগ্রামে নবিশ উকিলের বিয়ে প্রতারণার শিকার তরুণী পোশাককর্মী

নির্যাতনে নষ্ট গর্ভের সন্তান, কাবিন বানানো হয় দুবার

চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন জান্নাতুল নাহার সুমাইয়া (২৩)। স্বামীর হাতে নির্যাতিত হয়ে চট্টগ্রামের একটি আদালতে মামলা করেন তিনি। মামলার সূত্রে আদালতে যাওয়া-আসা হতো তার। সেখানে পরিচিত হয় তার মামলার আইনজীবীর ‘জুনিয়র’ হিসেবে কর্মরত এক শিক্ষানবিশ আইনজীবী আমজাদ হোসাইনের সঙ্গে। এরই মধ্যে দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। একপর্যায়ে আগের স্বামীকে তালাক দেওয়ার প্ররোচনা দেন আমজাদ। বিশ্বাস করে নতুন সংসার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে তালাকও দেন সুমাইয়া। পরে আমজাদ নিজেই বিয়ে করেন সুমাইয়াকে।

তবে বিয়ের কাবিননামায় আমজাদ গোপন করেন তার প্রকৃত নাম-ঠিকানা। বিষয়টি স্ত্রী সুমাইয়া জেনে গেলে প্রকৃত ঠিকানা দিয়ে পুনরায় বিয়ের কাবিননামা করেন শিক্ষানবিশ আইনজীবী আমজাদ হোসাইন।

কিন্তু এরপর থেকেই সুমাইয়ার ওপর শুরু হয় নির্যাতন। নষ্ট করে দেওয়া হয় তার পেটের সন্তান। সুমাইয়ার কাছ থেকে আমজাদ হাতিয়ে নেয় বড় অংকের টাকাও। নির্যাতনের পর সুমাইয়া মৃত সন্তান জন্ম দিলে একপর্যায়ে লাপাত্তা হয়ে যান আমজাদ। আট মাস ধরে আমজাদের খোঁজ না পাওয়ায় আদালতের দ্বারস্থ হন সুমাইয়া।

বুধবার (১৪ অক্টোবর) সকালে চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আইরিন পারভিনের আদালতে দায়ের করা অভিযোগের বিষয়ে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের কথা ছিল। পরে এজাহারে উল্লিখিত সাক্ষীরা হাজির না হওয়ায় আগামী ১০ নভেম্বর সাক্ষী গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করেন আদালত। সাক্ষ্যগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সুমাইয়ার আইনজীবী মো. কবির।

অভিযুক্ত শিক্ষানবিশ আইনজীবী আমজাদ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার ছোট ঢেমশা এলাকার কালিবাড়ির মনির আহম্মদ সিদ্দিকীর পুত্র। তিনি চট্টগ্রাম জেলা কোর্ট বিল্ডিং শাপলা ভবন ৩৬-সি কক্ষে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির এক সদস্যের সঙ্গে শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন।

জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৯ আগস্ট আমজাদ হোসাইনের সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়েতে আবদ্ধ হন জান্নাতুল নাহার সুমাইয়া। আমজাদ হোসাইন বিয়ের কাবিনে উল্লেখ করেন, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার ছোট বারদোনা কালি বাড়ির সুলতান আহম্মদের পুত্র তিনি। পরে শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গেলে সুমাইয়া জানতে পারেন তার স্বামীর প্রকৃত নাম ও ঠিকানা। এ বিষয়ে সুমাইয়া আপত্তি জানালে চলতি বছরের ৯ মার্চ আমজাদ হোসাইন তার প্রকৃত নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করে বিয়ের কাবিননামা সংশোধন করেন।

অভিযোগ রয়েছে, প্রায় ৬ মাস আগে সাতকানিয়ার শ্বশুরবাড়িতে স্বামী আমজাদের সঙ্গে বেড়াতে যান সুমাইয়া। ওই সময় গর্ভবতী ছিলেন তিনি। বিষয়টি জানতে পেরে গর্ভের সন্তান নষ্ট করতে সুমাইয়াকে গোপনে খাওয়ানো হয় ওষুধ। ওই সময় আমজাদের বোনসহ কয়েকজন নিকটাত্মীয়ের নির্যাতনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন সুমাইয়া। অসুস্থতার একপর্যায়ে সুমাইয়াকে সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে সুমাইয়া মৃত সন্তান প্রসব করেন।

এরপর থেকে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন সুমাইয়া। গত ৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে বাসায় ফেরেন তিনি। কিন্তু এরপর থেকে স্বামী আমজাদ তার আর খোঁজ রাখেননি।

মামলা সূত্রে জানা যায়, পেশায় পোশাকশ্রমিক সুমাইয়ার কাছ থেকে বিয়ের পর তালাক ও নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে টাকা নিতেন আমজাদ হোসাইন। অন্যজন থেকে ধার করে সুমাইয়া আমজাদকে এনে দেয় আড়াই লাখ টাকাও। এ টাকার বিপরীতে আমজাদ তাকে একটি বেসরকারি ব্যাংকের চেক দেন। দীর্ঘদিন ওই পাওনাদারের টাকা ফেরত না দেওয়ায় গত ৩০ মার্চ আমজাদের বিরুদ্ধে একটি চেক প্রতারণা মামলা দায়ের করা হয়।

এর আগে চলতি বছরের ৫ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের একটি আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলাটি বর্তমানে চলমান রয়েছে।

ভুক্তভোগী জান্নাতুল নাহার সুমাইয়া বলেন, ‘আমি আমার আগের স্বামীর বিষয় নিয়ে আমার আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে আমজাদ হোসাইনের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে আমার স্বামীকে তালাক দিতে আমজাদ প্ররোচনা দেয়। আমি তার কথা মত স্বামীকে তালাক দিই। পরে আমজাদের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। এ বিয়ের সময় প্রথম কাবিননামায় সে মিথ্যা ঠিকানা দেয়। পরে বিষয়টি আমি জানতে পারলে আবার সঠিক ঠিকানা দিয়ে বিয়ের কাবিন বানায় সে।’

সুমাইয়া আরও ববলেন, ‘ওই সময় আমজাদ বেকার ছিল। সংসারের খরচ মেটাতে আমার কাছ থেকে বিভিন্ন সময় টাকাও নিতেন। এমনকি তার ব্যবসার জন্য আড়াই লাখ টাকা আরেকজনের কাছ থেকে ধার করে এনেও দিই। তার বিপরীতে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের একটি চেকও দেয় আমজাদ। শ্বশুরবাড়ির নির্যাতনের কারণে আমার গর্ভের সন্তানটি মারা যায়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমার সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। তার বিরুদ্ধে চেকের মামলাসহ মোট দুটি মামলা চলমান রয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষানবিশ আইনজীবী আমজাদ হোসাইন বলেন, ‘এসব মিথ্যা। মেয়েটি খারাপ। নিউজটি না করলে ভালো হয়।’

মুআ/এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!