চট্টগ্রামে দুই বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে ৬০০ অবৈধ সংযোগ, বায়েজিদের চক্রের পকেটে কোটি কোটি টাকা

চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানার মাঝের ঘোনা ও ইসলামপুর এলাকা। ঝুঁকিপূর্ণ এই পাহাড়ি এলাকায় অবৈধভাবে বিদ্যুতের সংযোগ দিয়ে বাণিজ্য করছে একটি চক্র। গ্রাহকদের জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি কোটি কোটি টাকা।

অন্য এলাকার নাম দিয়ে নেওয়া হয়েছে দুটি বৈধ মিটারের সংযোগ। এ দুটি মিটার থেকে সাব-মিটার দিয়ে প্রায় ৬০০ পরিবারকে দেওয়া হয়েছে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ।

দীর্ঘ ৮ বছর ধরে চক্রটি এ বাণিজ্য করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনো বিষয়টি জানে না। ঘরপ্রতি বিদ্যুতের দিয়ে গ্রাহক থেকে আদায় করা হচ্ছে সরকার নির্ধারিত রেটের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি রেট।

সূত্র বলছে, ষোলশহর বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রের এক উপসহকারী প্রকৌশলীর সঙ্গে যোগসাজশ করে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুতের লাইন। বিদ্যুৎ সংযোগের ভারসাম্য রক্ষা করতে সেখানে বসানো হয়েছে একটি ট্রান্সফমারও।

বিদ্যুতের প্রতিটি নতুন সংযোগ ও মিটার কিনতে অতিরিক্ত টাকাসহ প্রতি ইউনিট থেকে আদায় করা হচ্ছে কয়েকগুণ বিদ্যুৎ বিল। মাস শেষে প্রতিটি পরিবার থেকে বায়েজিদ বিদ্যুৎ সার্ভিস ও আলিফ মীম বিদ্যুৎ সার্ভিসের নামে উঠানো হচ্ছে এসব টাকা। বসতি নগর ও ইলামপুর এলাকার অন্তত ছয়শত পরিবারে এভাবে অবৈধপন্থায় বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে ব্যবসা করছে চক্রটি।

জানা গেছে, বায়েজিদ বিদ্যুৎ সার্ভিসের স্বত্ত্বাধিকারী শাহজাহান বাদশা প্রকাশ লাল বাদশা ও আলিফ মীম বিদ্যুৎ সার্ভিসের স্বত্ত্বাধিকারী মো. আব্বাস।

এর আগে বায়েজিদ থানা এলাকায় জালালাবাদ বসতি নগর এলাকায় প্রায় ৮ বছর আগে বৈধভাবে বিদ্যুতের দুটি আবাসিক সংযোগ নেওয়া হয় বায়েজিদ থানা আওয়ামী লীগের ‘কথিত’ উপদেষ্টা আব্বাস ও বদিউল আলমের নামে।

এসব অভিযোগ পেয়ে ২০২০ সালের ২৪ জুন বায়েজিদ বোস্তামী থানার মাঝের ঘোনা, আরেফিন নগর, বিশ্বকবর স্থান ও ইসলামপুর এলাকায় যৌথ অভিযান পরিচালনা করে পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ভূমি অফিস। ওইদিন অবৈধ বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মামলা দায়ের করে ষোলশহর বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ।

২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর এ মামলার অভিযোগপত্র জমা দেন বায়েজিদ থানার পুলিশের এসআই মো. জাহাঙ্গীর আলম। এ মামলায় প্রায় আড়াই লাখ টাকা বিদ্যুৎ চুরি করার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা।

মামলার আসামিরা হলেন বায়েজিদ থানার বসতি নগরের দুদু মিয়ার পুত্র শাহজাহান বাদশা (৪৫) ও মাঝের ঘোনা এলাকার মঞ্জুর আলমের পুত্র মো. খালেক, বাবুলের পুত্র রড মানিক, মৃত এরশাদ উল্লাহ ইউসুফ, শাহজানের ছেলে বাবুল, ইসহাকের ছেলে কারেন্ট রনি ও নাসিরের ছেলে মামুন। এদের সবার ঠিকানা মাঝের ঘোনা এলাকায়।

ওই এলাকায় প্রতিটি বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হচ্ছে সাব-মিটারসহ ১৭ হাজার টাকায়। এছাড়া সেখানে হঠাৎ বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে তার মেরামতের খরচসহ বিদ্যুতের কর্তৃপক্ষের লোকজন আসলে ঘরপ্রতি আরও অতিরিক্ত টাকা গুণতে হয়।

চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি বায়েজিদ থানার মাঝের ঘোনা এলাকায় আরিফের বাসা এমজি আবাসিক এলাকায় একটি ঘর থেকে বিদ্যুতের মোট ইউনিট চার্জ ৮৬৪ টাকা, মিটার চার্জ ২০ টাকাসহ মোট ৮৮৪ টাকা বকেয়া আদায় করেছে বায়েজিদ বিদ্যুৎ সার্ভিস। গত ৫ মার্চ একই ব্যক্তির নামে মোট ইউনিট চার্জ, মিটার চার্জ ও সার্ভিস চার্জসহ মোট এক হাজার ৯২ টাকা আদায় করেছে আলিফ মীম বিদ্যুৎ সার্ভিস। প্রতিটি পরিবার থেকে এভাবে গড়ে ইউনিট প্রতি নেয় তারা ১৭ টাকা করে।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের আদেশে বলা হয়, আবাসিকের লাইফ লাইন গ্রাহকদের শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে সেক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য ৩ টাকা ৭৫ পয়সা, সাধারণ গ্রাহকদের ক্ষেত্রে প্রথম শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিটের ৪ টাকা ১৯ পয়সা, দ্বিতীয় ধাপে ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিটের ৫ টাকা ৭২ পয়সা, তৃতীয় ধাপে ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিটের জন্য ৬ টাকা, চতুর্থ ধাপে ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ৩৪ পয়সা, পঞ্চম ধাপে ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের ৯ টাকা ৯৪ পয়সা এবং ষষ্ঠ ধাপে ৬০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে ইউনিট প্রতি ১১ টাকা ৪৬ পয়সা মূল্য ধরা হয়েছে।

স্থানীয়ররা জানান, মাঝের ঘোনা ও ইসলামপুর এলাকার কেউ যদি বৈধ উপায়ে মিটার ও বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে চাইলেও নিতে পারে না। কেউ যদি বিদ্যুৎ সংযোগ নিলে রাতে আধাঁরে ওই চক্রটি বিদ্যুতের সংযোগ কেটে দেয়। তাদের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহজাহান বাদশা প্রকাশ লাল বাদশা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে মুঠোফোনে বলেন, ‘এখানে শুধু আমি না, আব্বাস, লোকমান হাকিমরা রয়েছে। তাদেরও মিটার আছে। আমি ১৮০ পরিবারবে বিদ্যুতের সংযোগ দিয়েছি। আমাকে আদালত অনুমতি দিয়েছে।’

বসতি নগরের বৈধ মিটারের সংযোগ নিয়ে অন্য এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে ব্যবসা করছেন কি-না এমন প্রশ্ন করলে তিনি মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

জানতে চাইলে লোকমান হাকিম কুতুবী বলেন, ‘এটাতো আরও ৪-৫ বছরে আগের কথা। অভিযান চালানোর পর আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে বিদ্যুতের অফিস। এখন আমি নেই। মামলাও শেষ। দুটি মিটারের মধ্যে বদিউল আলমের নেওয়া মিটার সংযোগটি আদালতের মাধ্যমে সেরেন্ডার করা হয়েছে। এখন কারা সেখানে অবৈধ বিদ্যুতের ব্যবসা করছে সেটা আমি বলতে পারবো না।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ষোলশহর বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রের উপসহকারী প্রকৌশলী খোরশেদ আলম বলেন, ‘আপনি অফিসে এসেই বিষয়টি জানান। তারপর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জানতে চাইলে ষোলশহর বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী নুর উদ্দিন আহমেদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আপনি আমাকে তথ্য পাঠান। এরপর বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নেওয়া হবে।’

এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!