চট্টগ্রামে থানায় নারীর মিথ্যা অভিযোগ, তদন্তে ওঠে এল পুরোটাই সাজানো

বাদির বিরুদ্ধে আদালতের সমন

থানায় মিথ্যা অভিযোগ করায় বিবি মরিয়ম বেগম নামে চট্টগ্রামের এক নারীর বিরুদ্ধে সমন জারি করেছেন আদালত।

বুধবার (২৯ মার্চ) চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল দেবের আদালত এই সমন জারি করেন।

জানা গেছে, গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর উত্তর কাট্টলী এলাকার বাসিন্দা বিবি মরিয়ম বেগম আকবরশাহ থানায় ছেলেকে মারধরের অভিযোগ করেন।

সেই অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, তার ছেলে মো. ফয়সাল উদ্দীন ও ফাহাদ উদ্দীনকে মারধর করে একই এলাকার বাসিন্দা মোক্তার হোসেন। পরিবারের লোকজনকে বিভিন্ন প্রকার হুমকি দেওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয় অভিযোগে।

কিন্তু অভিযোগের প্রেক্ষিতে আদালতে দেওয়া পুলিশের প্রতিবেদনে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাদী বিবি মরিয়ম বেগম ও বিবাদী মোক্তার হোসেনের মধ্যে জমি সংক্রান্ত বিরোধ রয়েছে। বিবাদীপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে পাওয়া রায় ডিক্রি অনুযায়ী বিরোধীয় জমিতে বৈধভাবে বাড়ি নির্মাণ কাজ শুরু করেন। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর বিবাদী মোক্তার হোসেন নির্মাণ সামগ্রী আনার সময় বাদী মরিয়মের ছেলে ফয়সাল গালাগালি করতে থাকে। একপর্যায়ে মোক্তারকে ফয়সালসহ বাদি পক্ষের লোকজন তাকে মারধর করে। এরপর আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন মোক্তার হোসেন।

পরে ২৪ সেপ্টেম্বর মোক্তার হোসেনকে ফাঁসাতে আকবর শাহ থানায় মিথ্যা সাধারণ ডায়েরি করেন বিবি মরিয়ম। সাধারণ ডায়েরি আদালতের অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে আকবর শাহ থানার ওসি (তদন্ত) শাকের আহমেদ সরেজমিন ও গোপনে তদন্ত করে আদালত প্রতিবেদন দাখিল করেন। আদালত তদন্ত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করায় বাদী মরিয়মের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২১১ ধারায় সমন জারি করেন।

জানা গেছে, নগরীর আকবরশাহ থানাধীন উত্তর কাট্টলীর মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনের নির্মাণাধীন বাড়িতে গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে ইটভর্তি একটি ট্রাক আনার পরপরই বাড়ির রাস্তার মুখে বাধা দেয় একদল লোক। এ সময় বাড়ির মালিক বীরমুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনের ছেলে মোক্তার হোসেন বাধা দেওয়ার কারণ জানতে গেলে তার ওপর একযোগে চালানো হয় নারকীয় হামলা। এ সময় আকবরশাহ থানার সন্ত্রাসী তালিকা থেকে সদ্য নাম বাদ যাওয়া চটপটি আলাউদ্দিনের স্ত্রী বিবি মরিয়ম ও ছেলে ফয়স‌াল ওর‌ফে গু‌টি ফয়স‌াল ও ফরহাদ, তার বোন জামাই খোরশেদ আলমের পুত্র এমরান, ফোরকান ও দৌলত একযোগে মোক্তার হোসেনকে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি মেরে গুরুতরভাবে জখম করে। পরে মোক্তারের আর্তচিৎকারে পাশ্ববর্তী মহাসড়ক থেকে পথচারীরা এগিয়ে এলে দুর্বৃত্তের দল হুমকি দেয়, ভবিষ্যতে জায়গাটিতে কোন নির্মাণকাজ করা হলে বীরমুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনের পরিবারের সদস্যদের একে একে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলবে।

ঘটনার পর মোক্তার হোসেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। মেডিকেল রিপোর্টে চিকিৎসকরা এলোপাতাড়ি হামলায় মোক্তারের মাথায় ‘হেড ইনজুরি’ শনাক্ত করেন।

এই ঘটনায় গত ২৪ সেপ্টেম্বর মোক্তার হোসেনের বড় ভাই এডভোকেট এএইচএম জাহিদ হোসেন নগরীর আকবরশাহ থানায় মামলা করতে গেলে থানার ওসি মামলা না নিয়ে একটি জিডি (নম্বর ১৪৬১/২২) লিখিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, আলাউদ্দিন ওরফে চটপটি আলাউদ্দিন হত্যা মামলাসহ ১৪টির বেশি মামলার আসামি। তার নামে বিভিন্ন থানায় সাতটি জিডি রয়েছে। আকবর শাহ থানার সন্ত্রাসী তালিকা থেকে রহস্যজনকভাবে নাম বাদ যাওয়া চটপটি আলাউদ্দিন বর্তমানে হত্যা মামলায় কারাগারে রয়েছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য দিদারুল আলমের ছত্রছায়ায় আলাউদ্দিনের ছেলে ফয়সাল উরফে গুটি ফয়সাল ও ফরহাদ ওরফে বাবা ফরহাদ মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনের পরিবারের উপর একাধিকবার হামলা চালায়।

জানা গেছে, নগরীর আকবরশাহ থানার উত্তর কাট্টলী ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বীর মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনের মালিকানাধীন একটি জায়গা দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রাখেন আকবরশাহ থানার সন্ত্রাসী তালিকা থেকে রহস্যজনকভাবে নাম বাদ যাওয়া আলাউদ্দিন ওরফে চটপটি আলাউদ্দিন। এ নিয়ে আইনি লড়াই শেষে ২০২১ সালের ১ ন‌ভেম্বর সিভিল রিভিশন মূলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনকে বিনা বাধায় কাজ করার আদেশ দেন সংশ্লিষ্টদের। পরে প্রতিপক্ষ সুুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে গেলেও মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনের পক্ষে দেওয়া ২০২১ সালের ১ ন‌ভেম্বরের আদেশই বহাল থাকে। প্রতিপক্ষ পুনরায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে লার্জেস্ট বেঞ্চে গেলেও মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনের পক্ষে দেওয়া হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন।

অভিযোগে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনকে তার মালিকানাধীন জায়গায় নির্মাণকাজ করার জন্য উচ্চতর আদালত থেকে অনুমতি দেওয়া হলেও গত দুই বছর ধরে এই চক্রটি বারবার মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের ওপর হামলা চালিয়ে আসছে। অথচ পরিবারটি বাস্তবে কখনোই আইনি কোন সহায়তা পায়নি পুলিশের পক্ষ থেকে। গত বছরের নভেম্বরেও এই একই চক্র দা-বটি নিয়ে নির্মাণাধীন ভবনের শ্রমিকদের ওপর হামলা চালালেও পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা পায়নি অসহায় পরিবারটি।

অথচ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভা‌গের ২৯৪৯/২১ নম্বর আদেশে বীর মু‌ক্তি‌যোদ্ধা জা‌কির হো‌সেনের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দেওয়ার সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।

গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর বীরমুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনের পরিবারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা চেয়ে চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার বরাবর একটি চিঠি দেওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে গত ১১ মে সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (পশ্চিম) বরাবরে পাঠানো আকবরশাহ থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) এম সাকের আহমেদের দেওয়া প্রতিবেদনেও উল্লেখ রয়েছে, মহামান্য উচ্চ আদালত কর্তৃক নির্মাণকাজে বাধা না সৃষ্টি করা সংক্রান্তে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা বলবৎ রয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে এও উল্লেখ করা হয়, ‘উক্ত বিরোধীয় সম্পত্তিতে বীর মুুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেন গং কর্তৃক নির্মাণ কাজে ইসহাক ও আলাউদ্দিন গং বাধা সৃষ্টি করা আইনগত অবৈধ বিধায় উক্ত রূপ বাধা প্রদান করিলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে বিধিমোতাবেক পুলিশী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’

ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, এই চক্রটিকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় সাংসদ দিদারুল আলমও। মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনের নির্মাণাধীন বাড়ি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও ভূমিদস্যু চক্রের জন্য তিনি লিখিত সুপারিশ করেছেন পুলিশ কমিশনারের কাছে।

আরএম/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!