চট্টগ্রামে ডায়রিয়া রোগীর নতুন ঝুঁকি ‘হাইপোভোলেমিক শক’, বয়স্ক ও শিশুরাই ভুগছে বেশি

চট্টগ্রামে ডায়রিয়ার প্রকোপ কিছুটা কমে আসলেও নতুন করে দেখা দিয়েছে ‘হাইপোভোলেমিক শক’। বেশিরভাগ রোগী সুস্থ হয়ে ফিরলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘটছে এই ব্যতিক্রম। মূলত শরীর থেকে বেশিরভাগ পানি বের হয়ে যাওয়ার ফলে শকে চলে যাচ্ছে রোগী। কয়েকদিন ধরে হাসপাতালে মিলছে এই ধরনের রোগী। এসব রোগীর মধ্যে বয়স্ক ও শিশু বেশি। এছাড়া অনেক রোগীর শরীরের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কলেরার জীবাণুও পাওয়া গেছে।

তবে চিকিৎসকরা এই ধরনের রোগী পর্যবেক্ষণে রাখলেও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা, ডায়রিয়া হলে স্যালাইন ও ডাবের পানি খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।

জানা গেছে, কোনো কোনো রোগীর ডায়রিয়ার শুরুতেই শরীরের সব পানি বের হয়ে শকে চলে যাচ্ছেন। চিকিৎসকরা এটিকে বলছেন ‘হাইপোভোলেমিক শক’ (hypovolemic shock)। একজন মানুষের শরীরে ৭০ শতাংশ পানি থাকে, ৭ থেকে ৮ লিটার পানি বের হয়ে গেলেই রোগী শকে চলে যাচ্ছে।

সোমবার (২৯ মে) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, শিশু বহির্বিভাগে প্রায় ১০০ জন রোগীর মধ্যে পাঁচ-ছয়জন রোগী ডায়ারিয়ার। এদের মধ্যে দু’জন ছিলেন শকের রোগী।

এমনই এক রোগী চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমানের ৮ বছর বয়সী ছেলে রোহান। গত ২৬ মে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাকে শমসেরপাড়া চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল ডেন্টাল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরেরদিন কিছুটা সুস্থ হলে হাসপাতাল থেকে রোহানকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। বাসায় আসার পরেরদিন দুপুরে আবারও ডায়রিয়া শুরু হলে তার শরীরের প্রায় পানি বের হয়ে যায়। এরপর শকে চলে যায় সে। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তার ব্লাড প্রেসার পাচ্ছিলেন না ডাক্তার। তবে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে প্রায় আধ ঘণ্টা পর ফিরে আসে রোহান। ঘণ্টাখানেক বিরতিহীন স্যালাইন পুশ করা হলে ব্লাড প্রেসার স্বাভাবিক হয় রোহানের।

ডায়রিয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপেরও পোস্ট করে সমস্যার কথা জানাচ্ছেন অনেক ভুক্তভোগী। শুভ আচার্য নামের একজন চট্টগ্রামভিত্তিক ফেসবুক পেইজ ‘ডেসপারেটলি সিকিংয়ে’ লেখেন, ‘চট্টগ্রামে হঠাৎ ডায়রিয়া, ডায়রিয়ার ভাব বেড়ে যাওয়ার কারণ কি? আমার নিজেরও ১ সপ্তাহ যাবৎ ডায়রিয়ার ভাব হচ্ছে। অনেকে বলছে ওয়াসার পানির কারণে হচ্ছে। ওয়াসার পানি ফুটিয়ে ফিল্টার করে খাওয়া হয়। কিন্তু আগেও তো কোনো সমস্যা হয়নি। শেষ এক সপ্তাহ যাবৎ সবার দেখছি সমস্যা শুরু হয়েছে। আর ওয়াসার পানি থেকেও এক ধরনের একটা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।’

তবে চিকিৎসকদের মতে, ওয়াসার পানি ফুটিয়ে খেতে হবে। পানিতে যতই জীবাণু থাকুক, ৫ থেকে ১০ মিনিট ফোটালে তা জীবাণুমুক্ত হয়ে যায়।

এরমধ্যে ডায়রিয়া বাড়ার কারণ জানতে এবং বিস্তার রোধ করতে চট্টগ্রাম মহানগরী এবং কয়েকটি উপজেলায় কাজ করছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) কর্মকর্তারা। তাদের ১২ সদস্যের একটি দল চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে পানিসহ বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করেছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিশু বহির্বিভাগের রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান (আরপি) ডা. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ডায়রিয়া আসলে কোনো ধরনের তা বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে শিশুদের ভাইরাল ডায়রিয়া শুরু হওয়ার ৩ থেকে ৪ দিন আগে থেকে সর্দি-কাশি এবং হালকা জ্বর হয়। এরপর পানির মতো তরল পায়খানা আরম্ভ হয়, সঙ্গে বমি এবং পেটে ব্যথাও হতে পারে। ভাইরাল ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে মলের মধ্যে পানির পরিমাণ বেশি থাকে, শ্লেষ্মা (মিউকাস) ততটা বের হয় না। খুব বেশি পানিশূন্যতা হলে শিশু পানিও খেতে চায় না। এছাড়া পানিশূন্যতায় শিশুর হৃদস্পন্দনের হার বেড়ে যায়, ত্বক ও জিভ শুষ্ক হয়ে যায়। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসও অপেক্ষাকৃত অনেক দ্রুত হয়ে যায়, রোগী শক চলে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘পানিশুন্যতা থেকে রোগী শকে চলে যাওয়াকে ‘হাইপোভোলেমিক শক’ বলে। এই রকম রোগী এখন সরচরাচর আসছে। তাই শিশু কিংবা বয়স্ক রোগী যেই হোক, ডায়রিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর ভালো না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতালে থাকতে হবে। এরপর নিতে হবে ফলোআপ চিকিৎসা।’

চিকিৎসা ক্ষেত্রে রোগী ও স্বজনদের কিছু ভুলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ঠিক আধ লিটার পানিতেই এক প্যাকেট স্যালাইন মেশাতে হবে। পানির পরিমাণ কম বা বেশি হওয়া যাবে না। অনেক রোগীর অভিভাবক বা স্বজন ডাবের সঙ্গে স্যালাইন মিক্সড করে খাওয়ান, তা করা যাবে না। স্যালাইনের পাশাপাশি স্বাভাবিক পানিও পান করতে হবে, ঘরের তৈরি খাবার খাবে। পানি ৫ থেকে ১০ মিনিট পর্যন্ত ফুটিয়ে পান করতে হবে।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জয় বলেন, ‘এটি ভাইরাল ডায়রিয়া কি-না বলতে পারছি না। পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বলা যাবে না। এখনও পর্যন্ত আমরা এটিকে সচরাচর যে ডায়রিয়া হয় সেটাই বলছি।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!