চট্টগ্রামে ডাক্তারের চেম্বার কবে খুলবে জানে না কেউ, হন্যে হয়ে ঘুরছে রোগীরা

ষাটোর্ধ্ব ডায়াবেটিসের রোগী হাসনাহেনা আক্তার আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা। ইদানিং হঠাৎ হঠাৎ বুকের ব্যথায় ভোগেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে ডাক্তারের চেম্বার বন্ধ। তাই শেষ ভরসা সরকারি হাসপাতাল। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা নিয়ে গত ২ জুন চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গেলেও ভর্তি নেয়নি হাসনাহেনা আক্তারকে। কয়েকটি ওষুধ দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। টেলিমেডিসিন সেবা নিতে বারকয়েক ডাক্তারের পরামর্শের জন্য ফোন করেও সাড়া পাননি হাসনাহেনার স্বজনরা। শেষে কমপাউন্ডারকে বলে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে তা খেয়ে বাসায় আইসোলেশন আছেন তিনি।

আরেক রোগী নোয়াখালীর বাসিন্দা নাহার বেগম দেড় বছর ধরে কোমরের ব্যথায় ভুগছেন। মাসে মাসে চট্টগ্রাম এসে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধপত্র নিয়ে যান। চলতি বছরের শুরুতে হঠাৎ স্ট্রোক করলে ছেলে নাজমুল চমেক হাসপাতালে ভর্তি করান তাকে। চারদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর ডাক্তার জানান, নাহার বেগম কিডনির সমস্যায় ভুগছেন। সাথে ডায়াবেটিসও আছে। গত ২৫ মার্চ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার তারিখ থাকলেও করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনে আটকা পড়েন। ডাক্তারের মোবাইল নম্বর না থাকায় টেলিমেডিসিন সেবাও নিতে পারছেন না নাহার বেগম। আগের ওষুধের ব্যবস্থাপত্রে চলছে চিকিৎসা। শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে এভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ দিন কাটাচ্ছেন নাহার বেগম।

শুধু হাসনাহেনা আক্তার বা নাহার বেগম নন, জটিল রোগের রোগীদের প্রায় সবারই এমন দশা। গত ৮ মার্চ দেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার পরই ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে ডাক্তারদের ব্যক্তিগত (প্রাইভেট) চেম্বার। করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে একসময় ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ রোগী দেখা বন্ধ করে দেন প্রায় সব বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই। গুটিকয়েক ডাক্তার চেম্বার চালু রাখলেও এপ্রিলের শুরুর দিকেই সরকারি হাসপাতালের বাইরে রোগী দেখা শূন্যের কোটায় চলে যায় প্রাইভেট চেম্বারগুলোতে। সংক্রমণের পর তিন মাস কেটে গেলেও সেই দৃশ্যপট বদলায়নি একটুও। প্রাইভেট চেম্বারগুলোর দরজা আর খুলছেই না।

করোনা বাহকের সংস্পর্শেই যেহেতু করোনার বিস্তার, তাই যতদিন না করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে ততদিন চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই ব্যক্তিগত চেম্বার— প্রায় সব ডাক্তারই এমন কথা জানাচ্ছেন। এ কারণে বিপাকে পড়েছেন জটিল রোগের রোগীরা। পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে, কবে ডাক্তারের চেম্বার খুলবে আর কবে মিলবে রোগের চিকিৎসা— এসব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারও।

চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত অনেক চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের মৃত্যুও হয়েছে। এ কারণেও সরকারি হাসপাতালের বাইরে ব্যক্তিগত চেম্বার চালুর আগ্রহ নেই অনেক চিকিৎসকের। টেলিমেডিসিন সেবাই এখন একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু এ নিয়েও অভিযোগ রোগীদের। টেলিমেডিসিন সেবা কেবল নামেই। পছন্দসই ডাক্তারের পরামর্শ পাওয়া যায় না।

ব্যক্তিগত চেম্বার চালুর বিষয়ে চমেক হাসপাতালের ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, ‘রোগীদের ট্রিটমেন্টের ক্ষেত্রে সামনাসামনি সেবার বিকল্প নেই। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে চেম্বার চালুরও উপায় নাই। প্রথম কারণ আমার চেম্বার ছোট। রোগীদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। একজনের জন্য অনেকে বিপদে পড়তে পারে। ডাক্তার হয়ে তা তো করতে পারছি না। রোগীদের জন্য পরামর্শ থাকবে যতটা সম্ভব টেলিমেডিসিন সেবা নিয়ে বাসায় থাকা। যদি কন্ডিশন ক্রিটিকাল হয় তাহলে দেরি না করে হসপিটালে চলে যাওয়া। তাছাড়া এ মুহূর্তে আর কোন উপায় নেই।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক চিকিৎসক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পটিয়া, সীতাকুণ্ড, বোয়ালখালী ও রাউজানে আমার চেম্বার আছে। লকডাউন থাকায় যাতায়াতের কারণে চেম্বার বন্ধ ছিল। পরিস্থিতি ভালো হলে সামনে হয়তো চালু হবে। কিন্তু অবস্থা ভালো না হলে তাও বলা যাচ্ছে না। আমার অনেক পেশেন্ট আছে যাদের প্রায় আমাকে দেখাতে আসতেন। তাদের জন্য খারাপ লাগে। কিন্তু কিছুই করার নেই। আমি তাও চেম্বার খোলা রাখতাম। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত গাড়ি নাই। আমাকে গণপরিবহন ব্যবহার করতে হবে। আর এটা এই সময় অনেক রিস্ক। বাসায় আমার বয়স্ক বাবা-মা, ছোট বাচ্চা আছে— তাদের কথাও তো ভাবা উচিত।’

একই প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের নামি এক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘শুরু থেকেই চেম্বার বন্ধ। রোগীদের টেলিমেডিসিন সেবা দিচ্ছি। হোয়াটসঅ্যাপ-মেসেঞ্জারে ভিডিও বা ছবি পাঠাতে বলি। তারাও সমস্যার কথা লিখে পাঠায়। তখন সমস্যা দেখে সেবা দিচ্ছি। তবে সামনাসামনি সেবার তো বিকল্প নাই। সমস্যা তো অবশ্যই হবে।’

এমন পরিস্থিতিতে ভবিষ্যৎ চিন্তা কী— এ প্রসঙ্গে ওই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ‘এখন চেম্বার করে আর কী হবে? কোনদিন নিজে আক্রান্ত হয়ে না আবার মারা যাই। আমি বাঁচলে না রোগীদের সেবা করবো। অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি বলতে গেলে। টেলিমেডিসিন সেবাতেই রোগীর খোঁজখবর নিচ্ছি। তাছাড়া সত্যি সবাই নিরুপায়।’

করোনাভাইরাসে কে আক্রান্ত বা কে আক্রান্ত নয়— তা বোঝা কঠিন। অনেকের উপসর্গ থাকা সত্বেও তিনি করোনায় আক্রান্ত নন। আবার অনেকের উপসর্গ না থাকার পরেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ইতিমধ্যে করোনা উপসর্গ নিয়ে অনেক রোগীর মৃত্যুও হয়েছে। কিন্তু এ পরিস্থিতি আরও কয়েক মাস টানা চলতে থাকলে অন্যান্য জটিল রোগীদের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে বলে মন্তব্য করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে চট্টগ্রামের প্রবীণ চিকিৎসক মাহফুজুর রহমান বিষয়টা চিন্তা করছেন ভিন্নভাবে। তিনি বললেন, ‘করোনা কবে যাবে তা বলা যাচ্ছে না। করোনার ভয়ে অনেক ডাক্তার তাদের প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ রেখেছেন দীর্ঘদিন ধরে। প্রথম প্রথম রোগটিকে জানতে এবং বুঝতে বন্ধ রাখার যুক্তি ছিল। এখন তো নিশ্চিত হওয়া গেছে কিভাবে করোনা ছড়ায় এবং কিভাবে ছড়ানো প্রতিহত করা যায়। এখন তো চেম্বারে বসা যায়। নিজেকে সুরক্ষিত রেখে রোগী দেখতে অসুবিধা থাকার কথা নয়। রোগীরা বেশ কষ্টে আছে। আমাদের করোনা চিকিৎসকদের দেখুন। না জেনে, না বুঝেই করোনার বিরুদ্ধে কী সাহস নিয়ে রোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সাথী অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু তারা ভয় পেয়ে হাসপাতাল ছেড়ে দেননি। এখন অধিক জ্ঞান নিয়ে ভয়হীনভাবে চিকিৎসা দিচ্ছেন। তাদের থেকে সাহস সঞ্চয় করে সব ডাক্তারকে চেম্বারে বসার আহ্বান জানাচ্ছি। সব রোগীরই করোনা আছে, সাথে অন্য রোগ— এটা মনে করে নিজেকে সুরক্ষিত রেখে চিকিৎসা সেবা শুরু করুন।’

এ বিষয়ে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. মিনহাজ রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে এখন জ্বর আর শ্বাসকষ্টের রোগীরা খুব কষ্ট পাচ্ছে— এটা স্বীকার করতেই হবে। এর বাইরে যারা আছে তারাও করোনার ভয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে না। সামনাসামনি চিকিৎসা আর টেলিমেডিসিনের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। আর এতেও রোগীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এখন যদি ঢালাওভাবে চেম্বার চালু করে দেয় তাহলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে, এটাও ঠিক। এখন এসব মাথায় রেখে কিভাবে চিকিৎসা দেওয়া যায় তাই ভাবা উচিত। প্রায় তিন-চার মাস হয়ে যাচ্ছে যারা রেগুলার চেকআপে ছিল, তারা সেবাটা সেভাবে পাচ্ছে না। এখন টেলিফোনে চিকিৎসা দেওয়া এটা কোন সমাধান না। হ্যাঁ, এতে সুবিধা হয়েছে। কিন্তু এটি স্থায়ী সমাধান হতে পারে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন টাইম শিডিউল করে যদি দশ জন রোগী দেখে, তাহলেও কিন্তু রোগীদের জন্য সুবিধা হয়। আগে ৪০ জন দেখতাম এখন না হয় ১০ জন দেখলাম। সময় শিডিউল করে দেখলে রোগীদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকবে। এক রোগীর সাথে অন্য রোগীর দেখা হলো না তাও হয়। এ নিয়ে সবার ভাবা উচিত। চিকিৎসাসেবা পাওয়ার অধিকার সবারই আছে।’

একই প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মোস্তফা খালেদ আহমদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা বিএমএর সাথে কথা বলেছি, ডাক্তাররা যাতে আস্তে আস্তে প্রাইভেট চেম্বার শুরু করে। বিএমএও চেষ্টা করছে। এখন বিশেষ করে যারা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে তারা যদি নিজে থেকে এগিয়ে না আসে, আমরা তাদের বাধ্য করতে পারি না। সরকারি ডাক্তারদের বাধ্য করলাম। কিন্তু প্রাইভেট প্র্যাকটিস যারা করছে তাদের বাধ্য করা যায় না। তাদের মোটিভেট করার চেষ্টা করছি, যাতে তারা আস্তে আস্তে চেম্বার করা শুরু করে। এটা নিশ্চয় হবে। কিন্তু কবে হবে বা আগের ডিসিপ্লিন কবে আসবে সেটা বলতে পারবো না। তবুও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি এ বিষয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ প্রথম কথা হচ্ছে অনেক ডাক্তার চেম্বার করতেছে। সবাই করতেছে না, তা না। দ্বিতীয় কথা প্রাইভেট চেম্বার নিয়ে কি সরকারি ডাক্তাররা কিছু বলতে পারে? তারপরও আমরা বেসরকারি ক্লিনিকের কাছে তালিকা চাচ্ছি যারা চেম্বার করে। তথ্য নিয়ে চেষ্টা করছি কিভাবে তাদের ফিরিয়ে আনা যায়।’

এসআর/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!