চট্টগ্রামে ডাক্তাররা নিজেদের সুরক্ষা নিয়েই চিন্তিত

জ্বর-সর্দির রোগী এলেও ভড়কে যাচ্ছেন অনেকে

করোনা আতঙ্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন বেড়েছে উদ্বেগ, বিস্ময়কর হলেও চিকিৎসকদের মনেও রয়েছে একই রকমের উদ্বেগ। কারণ রোগীদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ডাক্তাররাই রয়েছেন অনেকটা অরক্ষিত। আবার চট্টগ্রামের বেশিরভাগ ডাক্তারই জানেন না করোনাভাইরাসের রোগীদের জন্য সত্যিকার অর্থে কী করতে হবে? কিভাবে দিতে হবে তাদের চিকিৎসা। ফলে প্রায় সব চিকিৎসকই সাধারণ জ্বর-সর্দি-কাশি রোগী এলেও ভড়কে যাচ্ছেন আতঙ্কে। এছাড়া চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত করোনা শনাক্ত করার উপায় নেই। এখনও পর্যন্ত করোনা শনাক্ত করার কোনো কিট মন্ত্রণালয় থেকে আসেনি চট্টগ্রামে।

চিকিৎসকদের মনে থাকা উদ্বেগ ছড়িয়েছে প্রতিদিনকার চিকিৎসা দানের ক্ষেত্রেও। এর ফলশ্রুতিতে সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশি নিয়ে আসা রোগীরাও পাচ্ছেন না সঠিক চিকিৎসাসেবা। পদে পদে রোগীরা হচ্ছেন হয়রানি ও অবহেলার শিকার। করোনা সন্দেহে কাছে যাচ্ছেন না চিকিৎসকরা। কারণ হিসেবে বলছেন এখনও হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য কর্মীদের পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্টের (পিপিই) ঘাটতি রয়েছে। যদিও সংক্রমণ ঠেকাতে সব রকম প্রস্তুতি রয়েছে— এমন দাবি শুরু থেকেই করে আসছে হাসপাতালগুলোর কর্তৃপক্ষ।

১ হাজার ৩১৩ শয্যার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সব ধরনের রোগী আসায় এবং ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত রোগী থাকায় এই হাসপাতালে করোনাভাইরাস আক্রান্তরা এলে রোগটি অনেকের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকবে বলে মনে করছেন একাধিক চিকিৎসক। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকরাও নিরাপদ নন। ইতিমধ্যেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চার চিকিৎসক হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। তাই চট্টগ্রামেও চিকিৎসকদের মনে জন্ম নিচ্ছে নানা প্রশ্ন।

মেডিসিন বিভাগে কর্তব্যরত এক চিকিৎসক বলেন, ‘ডাক্তারদের যদি প্রটেকশন না থাকে, তারা নিজেরাই যদি রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকে তাহলে চিকিৎসা দেবে কারা? ঢাকা মেডিকেলের চারজন চিকিৎসক বর্তমানে হোম কোয়ারেন্টাইনে। তাহলে আমাদের কী হবে? প্রতিদিন এতো এতো রোগী আসে কি করেই বা বুঝবো কে করোনায় আক্রান্ত আর কে নয়! এখানে তো কিটও নেই যে কে আক্রান্ত হয়েছে তা শনাক্ত করা যাবে। ডাক্তার হয়েও অনেকটা অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দিয়েছি সব।’

আরেক চিকিৎসক বলেন, ‘সকলের মতন আমরাও বলছি প্রস্তুত আছি। কিন্তু বাস্তবতা আসলে কেমন, তা বাইরে থেকে টের পাওয়া কঠিন। কোনো রোগী থেকে যদি ভাইরাস আমার কাছে আসে আর তখন আমার কাছ থেকে আমার পরিবারও বাদ যাবে না। জেনেশুনে কী করে আমি ঝুঁকি নেবো? আগে তো আমাদের প্রটেকশন নিশ্চিত করা লাগবে।’

এদিকে করোনা আতঙ্কে অনেক চিকিৎসক প্রাইভেট চেম্বারেও রোগী দেখা কমিয়ে দিয়েছেন। অনেক চিকিৎসক প্রাইভেট চেম্বারে রীতিমতো লিখিত বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে দিয়েছেন, ‘জ্বর সর্দি কাশির রোগী দেখা হয় না।’ কয়েকদিন আগেও করোনা সন্দেহে জ্বরে আক্রান্ত দুই রোগীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে রোগী এবং স্বজনদের উপচেপড়া ভীড়। দেখে বোঝার উপায় নেই চট্টগ্রামকে কোভিড-১৯ এর উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সকলেই খুব স্বাভাবিক। কর্তব্যরত চিকিৎসকদের প্রায় সবাইকে দেখা গেছে সাধারণ পোশাকে।

জরুরি বিভাগের চিকিৎসককেও দেখা গেছে অন্য সময়ের মতন সাধারণ পোশাকে। তাদের মুকে মাস্ক থাকলেও ছিল না অ্যাপ্রোন কিংবা হাত গ্লাভস। টেবিলের ওপর হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল থাকলেও সেখানে স্যানিটাইজার নেই।

করোনাভাইরাস আক্রান্ত কেউ এসেছে কিনা— জানতে চাইলে জরুরি বিভাগের একজন চিকিৎসক বলেন, ‘নাহ, আমাদের এখানে এখনও কোনো রোগী আসেনি। তবে ওই সব রোগী আসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।’

জ্বর, সর্দি-কাশির উপসর্গ নিয়ে যারা আসছেন তাদের কী করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই সব রোগীদের মেডিসিন ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে সমস্যা দেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়।’

জানা যায়, চমেক হাসপাতালের সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এক হাজারের বেশি ডাক্তার রয়েছেন। নার্স ও অন্যান্য কর্মীসহ আরও হাজারখানেক। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দকৃত পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) রয়েছে ১ হাজার ৫০০টি। যেখানে একটি পিপিইর সর্বোচ্চ কার্যক্ষমতা ১০ ঘন্টা। এতো সংখ্যক মানুষের বিপরীতে উপকরণ যা নামমাত্র। এর ওপর পর্যাপ্ত পরিমাণে হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিংবা হেক্সিসলও নেই। তার পরিবর্তে সাবান ব্যবহারের কথা থাকলেও তাও কোথাও নেই। তবে চিকিৎসকদের একটি সূত্র জানিয়েছে, পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) যতটা বলা হচ্ছে, অতোটা এখনও নেই। এখন পর্যন্ত ৮০টি মাত্র পিপিই চমেক হাসপাতালে রয়েছে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে। তবে এর সত্যাসত্য চট্টগ্রাম প্রতিদিন তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করতে পারেনি।

ফলে সবমিলিয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে যায়, তাহলে মোকাবিলায় হিমশিম খেতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন একাধিক চিকিৎসক। এদিকে হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক অভিযোগ করেছেন প্রত্যেক ওয়ার্ডে হেক্সিসল, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান দেওয়ার কথা থাকলেও কোথাও তার অস্তিত্ব নেই। তাই প্রায় প্রত্যেকেই নিজেদের সর্তকতার জন্য বাইরে থেকে এনে সংরক্ষণ করছেন।

তবে এ প্রসঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন সদ্য যোগদান করা হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম হুমায়ুন কবীর। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। এখন সিজন চেঞ্জের সময়। এ সময় ভাইরাল ফ্লু, ইনফ্লুয়েঞ্জা এসব হয়ে থাকে। এটার কমন কিছু উপসর্গ থাকে। এক্ষেত্রে যদি না কোনো পেশেন্টের সিভিয়ার কন্ডিশন থাকে এবং পিসিআর করে কনফার্ম না হওয়া পর্যন্ত করোনা বলা যাবে না। যেহেতু এটা নিয়ে বিশ্বব্যাপী মহামারী পরিস্থিতি তাই সাধারণ ফ্লু হলেও মানুষ ভয় পেয়ে যায়। এখনও পর্যন্ত সেরকম কেস আমাদের এখানে আসেনি তবে ভাইরাল ইনফেকশনে কেস এসেছে। আর শনাক্ত হলেই আমাদের এখানে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের একটা টিমওয়ার্ক। আমরা রোগীদের সেবা দিতেই রয়েছি। যদি কোনো রোগী শনাক্ত হয় তাহলে তাকে অন্য কোথাও রেফার করা হবে না। তাছাড়া পাঁচ ডিপার্টমেন্টের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এই রোগীদের চিকিৎসা দেবেন। সেভাবেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।’

ডাক্তাররা কতটা ঝুঁকিমুক্ত সে প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে। মেডিসিন বেইজড সকল চিকিৎসক-নার্স ও স্টাফদের পার্সনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট দেওয়া হয়েছে, যারা এ রোগীদের সেবা দেবে। বিদেশ থেকে আগতদের প্রথমে হোম কোয়ারেন্টাইন বা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে। লক্ষণ দেখা দিলে আইসোলেশনে রাখা হবে সেখান থেকেই চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হবে। তাই সবাই নিজ নিজ দায়িত্বে সতর্ক রয়েছেন। ‘

এক প্রশ্নের জবাবে চমেক হাসপাতালের পরিচালক আরও বলেন, ‘বিশেষ পোশাক প্রতিদিন ১০টা করে ব্যবহার হলেও একমাসে যাবে ৩০০টা। সেক্ষেত্রে আমাদের কাছে আছে ১ হাজার ৫০০টি। আপাতত পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট যা আছে তা ভালোভাবে চলে যাবে যদি প্রয়োজন হয় সেভাবেই মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে।’

এ প্রসঙ্গে সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারেই সব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত ৯১ জন হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী এখনও শনাক্ত হয়নি। ডাক্তারেরাও নিজেরা সতর্ক হয়ে কাজ করছেন। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে এখনও পর্যন্ত আমরা সেরকম বাজে পরিস্থিতিতে পড়িনি। সংক্রমণ ঠেকাতে আমরা ব্যবস্থা রেখেছি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!