চট্টগ্রামে ডাক্তারদের ‘সিরিয়ালের’ ফাঁদে রোগীরা কাহিল, ১৫ মিনিটেই মোবাইল বন্ধ

সিরিয়ালের দ্বিগুণ দেখেন অনুরোধের রোগী

সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. সাকেরাকে দেখাতে সিরিয়ালের জন্য দেওয়া নম্বরে ফোন দেন নারী উদ্যোক্তা শিরিন আক্তার। পরিবারের তিনজন মিলে একসঙ্গে নম্বরটিতে ফোন দিতে থাকেন। কিন্তু প্রতিবারই নম্বরটি ব্যস্ত পাওয়া গেছে। এভাবে ২৫-৩০ বার চেষ্টা করেও কোনোভাবে সংযোগ পাওয়া যায়নি। সকাল ১০টায় চালু করা নম্বরটি ১০ মিনিট পর বন্ধ হয়ে যায়। শুধু মঙ্গলবার (২১ মার্চ) নয়, এর আগেও কয়েকদিন চেষ্টা করে তিনি ডাক্তারের নম্বর নিতে পারেননি।

চট্টগ্রামের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দেখাতে সিরিয়াল নম্বর নিতে এই চিত্র প্রতিদিনের। ডাক্তারদের সিরিয়াল নম্বর যেন ‘সোনার হরিণ’। প্রতিদিন বিভিন্ন রোগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা একেকজন ২৫-৩০ জনের বেশি রোগীর সিরিয়াল নেন না। আবার বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সিরিয়াল দেন নিজে। সিরিয়াল দেওয়ার নম্বরটি সর্বসাকুল্যে চালু থাকে মাত্র ১০ মিনিট। এই সময়ের মধ্যেই ডাক্তারের সিরিয়াল নিতে পারা যেন ‘লটারি’ জেতার সমান। এছাড়া অনুরোধের রোগীও তারা দেখেন চেম্বারে।

তবে কোনো কোনো ডাক্তারের চেম্বারের চিত্র এর বিপরীতও। বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল অথবা কার্ডে দেওয়া নম্বরে যোগাযোগ করে সহজেই অনেক ডাক্তারের নম্বর পেয়ে যান রোগীরা।

চট্টগ্রাম নগরীর বেসরকারি হাসপাতাল সিএসসিআরে চেম্বার করেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের বড় একটি অংশ। সেখানকার কয়েকজন ডাক্তার নিজেরাই সিরিয়াল দেন।

এদেরই একজন চট্টগ্রাম মেডিকেলের নিউরোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. হাসানুজ্জামান। তিনি সিএসসিআরে সপ্তাহে ৩-৪ দিন রোগী দেখেন। তার সিরিয়াল নেওয়ার সময় সকাল সাড়ে ৮টা থেকে শুরু। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ৮টা ৪০ থেকে ৮টা ৪৫ মিনিটের মধ্যেই সিরিয়ালের নম্বর বন্ধ হয়ে যায়। জানা গেছে, তিনি ১৫ থেকে ২০ জন রোগীর সিরিয়াল নিয়ে থাকেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ইব্রাহীম চৌধুরী সিএসসিআরে ব্যক্তিগত চেম্বার করেন। সকাল ৯টা থেকে তার সিরিয়াল নেওয়ার সময় নির্ধারিত থাকলেও তার সিরিয়াল বন্ধ হয়ে যায় ৯টা ১০ মিনিটের মধ্যে। তিনি সিরিয়াল নেন ১৫ জনের, কখনও ১০ জনও। ডা. ইব্রাহীম চৌধুরীও তার বাসা থেকেই নিজে সিরিয়াল নিয়ে থাকেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের গাইনি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সোয়েলা শাহনাজ সিএসসিআরে রোগী দেখেন সপ্তাহে চারদিন। তিনিও বাসা থেকে নিজে সিরিয়াল নিয়ে থাকেন। সকাল ৭টা থেকে তার সিরিয়াল নেওয়ার সময় নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু বড়জোর ১৫ মিনিটের মধ্যেই সিরিয়াল নেওয়ার ফোন ‘সুইচড অফ’ দেখায়।

ডায়াবেটিক ও হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইফতিখার হোসেন খানও বাসা থেকে সিরিয়াল নিয়ে থাকেন। সিরিয়াল নেওয়ার সময় সকাল সাড়ে ১০টা থেকে। তিনি সর্বোচ্চ ২০ জন রোগীর সিরিয়াল নিয়ে থাকেন বলে জানা গেছে। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সিরিয়াল নেওয়ার সময় থাকলেও শুরু থেকেই সিরিয়ালের জন্য নির্ধারিত মুঠোফোন নম্বর ব্যস্ত দেখায়। ১৫ মিনিটের মাথায় সেটিও ‘সুইচড অফ’ হয়ে যায়।

গাইনি বিশেষজ্ঞ ও সার্জন ডা. ফাহমিদা ইসলাম চৌধুরী সপ্তাহে পাঁচদিন চেম্বার করেন সিএসসিআরে। তিনিও বাসা থেকে রোগীর সিরিয়াল নিয়ন্ত্রণ করেন। সকাল ৭টা থেকে তার সিরিয়াল নেওয়ার সময় নির্ধারিত থাকলেও সোয়া ৭টার মধ্যেই তার সিরিয়ালের নম্বর বন্ধ হয়ে যায়। জানা গেছে, তিনি ২৫ থেকে ৩০ জন রোগীর সিরিয়াল ওই সময়ের মধ্যে নিয়ে থাকেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র আলাদা। ৫০ জনেরও বেশি রোগী তিনি দেখে থাকেন প্রতিদিন। সেগুলোর বেশিরভাগই অনুরোধের।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. ইলিয়াছ সিএসসিআরে রোগী দেখে থাকেন। এই বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞও বাসা থেকে সিরিয়াল নিয়ে থাকেন। তার সিরিয়াল নেওয়ার সময় সকাল ৮টা থেকে নির্ধারিত থাকলেও নির্ধারিত সময়ে ১০ মিনিটের মাথায় ফোন বন্ধ দেখাতে শুরু করে।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের কার্ডিওলজির সহকারী অধ্যাপক ডা. আনিসুল আওয়াল সিএসসিআরে ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখে থাকেন। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সিরিয়াল নেওয়ার সময় নির্ধারিত থাকলেও সেটি ১০ থেকে ১২ মিনিটের মাথাতেই বন্ধ দেখাতে শুরু করে।

ডা. সাকেরা আহমেদ চট্টগ্রাম মেডিকেলের সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তিনি সিএসসিআরে ব্যক্তিগত চেম্বার করেন। সপ্তাহে তিনদিন তিনি সিএসসিআরে চেম্বার করেন। তার সিরিয়াল নেওয়ার সময় সকাল ১০টা থেকে। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা যখন ১০টা ৮ মিনিট, তখনই তার সিরিয়াল নেওয়ার নম্বরটি বন্ধ হয়ে যায়। ডা. সাকেরা ফোনে ২০ থেকে ২৫ জনের সিরিয়াল নেন বলে জানা গেছে।

মেডিসিন ও গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিশেষজ্ঞ ডা. শামীম বকস্ সিএসসিআরে রোগী দেখেন প্রতি মঙ্গল ও বুধবার বিকেল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। সিরিয়াল নেওয়ার সময় সকাল ৯টা থেকে হলেও শুরু থেকেই তার সিরিয়ালের জন্য রাখা নির্ধারিত ফোনটি ব্যস্ত দেখায়। ঠিক ৮ থেকে ১০ মিনিটের মাথায় তার ফোনটি বন্ধ হয়ে যায়। ডা. শামীম বকস্ও বাসা থেকে সিরিয়াল নিয়ে থাকেন।

চট্টগ্রামের মেট্রো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিউরো মেডিসিনের ডাক্তার শিউলী মজুমদার রোগী দেখে থাকেন। তার সিরিয়াল নেওয়ার সময় সকাল ৮টা থেকে হলেও ১০ মিনিটের মাথায় তার ফোন নম্বরটি বন্ধ দেখাতে শুরু করে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সিরিয়াল পেতে একাধিক ফোন থেকে চেষ্টা করলেও সিরিয়াল পেতে ব্যর্থ হওয়ার কথা জানান অনেকে। ডা. শিউলী বাসা থেকে নিজেই সিরিয়াল নিয়ে থাকেন। তিনি ২৫ জনের বেশি রোগী দেখেন না বলে দাবি করলেও জানা গেছে, বাস্তবে ৪০ থেকে ৪৫ জন রোগী দেখে থাকেন। ফোনে অনুরোধের যেসব সিরিয়াল তিনি রাখেন, সেগুলো আলাদা খাতায় লেখা থাকে। যার প্রমাণ মিলেছে চেম্বারে তার ব্যক্তিগত এটেনডেন্টের কাছ থেকেও।

একই অবস্থা দেখা গেছে শেভরণ ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরিতে। নগরীর পাঁচলাইশের ও আর নিজাম রোডে অবস্থিত এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চট্টগ্রামের অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ব্যক্তিগত চেম্বার করে থাকেন। অনেকেরই অভিযোগ, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের অনেকে নিজেদের ‘ডিমান্ড’ বাড়াতে সিরিয়ালের জন্য ফোন খোলা রাখেন সামান্য সময়।

এদেরই একজন অধ্যাপক ডা. এম এ হাছান চৌধুরী। রোগীদের কাছে তার সিরিয়াল সোনার হরিণের মতোই। তিনি সিরিয়াল নিয়ে থাকেন নিজে, বাসা থেকেই। তাও শুধু শনি ও মঙ্গলবার বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে এক ঘণ্টাতো নয়ই, ১৫ মিনিটও খোলা পাওয়া যায় না সিরিয়ালের জন্য নির্ধারিত নম্বরটি। তিনি ২৫ থেকে ৩০ জনের সিরিয়াল নিয়ে থাকেন বলে জানা গেছে। বাস্তবে যদিও অনুরোধের ফোন পেয়ে ৫০ জনেরও বেশি রোগী দেখে থাকেন।

একইভাবে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মাহমুদুর রহমান চৌধুরী আরিফ, ডা. এরশাদ একরাম উল্লাহ, ডা. মোহাম্মদ সানাউল্লাহ শামীমও বাসা থেকে নিজে ২০ জন রোগীর সিরিয়াল নিয়ে থাকেন।

একই অবস্থা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু তারেক ইকবাল, ডা. নূরউদ্দিন তারেকেরও।

স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপিকা ডা. শামীমা সিদ্দিকা রোজী নিজে বাসা থেকে সিরিয়াল নিয়ে থাকেন। তার সিরিয়ালের জন্য নির্ধারিত সময় সকাল ৮টা থেকে হলেও সোয়া ৮টা পার হতেই নম্বরটি বন্ধ হয়ে যায়। তিনি ৩০ জনের বেশি রোগী দেখেন না বলে জানা গেছে।

এছাড়াও ডায়াবেটিক বিশেষজ্ঞ ডা. ফারহানা আক্তার, বক্ষব্যাধি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শিমুল কুমার ভৌমিক রয়েছেন, যাদের সিরিয়াল দেওয়ার নির্ধারিত নম্বরে ফোন করেও সিরিয়াল মেলে না।

কিন্তু এর বিপরীত চিত্রও দেখা গেছে অনেক ডাক্তারের ক্ষেত্রে। এদেরই একজন মেডিসিন, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিশেষজ্ঞ ডা. মো. জসীম উদ্দীন। তিনি চট্টগ্রাম নগরীর ন্যাশনাল হাসপাতাল ও পার্কভিউ হাসপাতালে ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখে থাকেন। তার ভিজিটিং কার্ডে যে নম্বরটি দেওয়া আছে, সেখান থেকে রোগীরা ভালোভাবে সিরিয়াল পেয়ে যান। তিনি ন্যাশনাল হাসপাতালে প্রতি মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার রোগী দেখে থাকেন। পার্কভিউ হাসপাতালে শনি, রবি, সোমবার রোগী দেখে থাকেন।

সিরিয়ালের বিষয়ে ডা. মো. জসীম উদ্দীন বলেন, ‘আসলে একেকজনের টেকনিক একেক রকম। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে রেফারেল রোগীদের যাওয়া উচিত। তবে সাধারণ রোগীরাতো আর সবকিছু বুঝে না। একজন রোগী কিংবা তার স্বজন ডাক্তারের খোঁজে ল্যাব বা বেসরকারি ক্লিনিকে যান। সেখানে তাদের দেওয়া হয় ভিজিটিং কার্ড। কিন্তু সেই কার্ডে দেওয়া নম্বরে ফোন দিয়েও সময়মতো সিরিয়াল পান না রোগী। তখন রোগী নিজেকে বঞ্চিত মনে করেন।’

তিনি বলেন, ‘এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া উচিত। সেসব রোগীর সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে সিরিয়াল না পাওয়ার কারণ জানতে চাওয়া উচিত। অবশ্যই তার অধিকার থাকবে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার।’

তবে সিএসসিআর হাসপাতালের এক্সিকিউটিভ (প্রশাসন) মো. রহমত উল্লাহ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘যেসব ডাক্তার বাসা থেকে সিরিয়াল নেন, তারাই পুরো বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করেন। এতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারে না।’

শেভরণের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এটি ডাক্তারদের একটা জাস্ট আইওয়াশ। নিজের ডিমান্ড বাড়ানোর অপকৌশল। ভেতরে তারা অনুরোধের ঢেঁকি গিলে অনেক রোগীই দেখে থাকেন।’

ডা. শিউলী মজুমদারের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার সিরিয়াল নিয়ে আগে এটেনডেন্টরা অনেক কারচুপি করেছে। তাই আমি এখন বাসা থেকে সিরিয়াল মেন্টেইন করি। আমি মাত্র ২৫ থেকে ৩০ জন রোগী দেখি। সেটি ১০ মিনিটও লাগতে পারে, ১০ সেকেন্ডও লাগতে পারে। সেটার জবাব আমি কাউকে দিতে বাধ্য নই। আর আমি কতজন রোগী দেখব, কি দেখব না—সেটা বলতেও কাউকে আমি বাধ্য নই।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!