চট্টগ্রামে টিভি চ্যানেল বিন্যাসে অপারেটরদের নৈরাজ্য, সঙ্গে বিপুল বাণিজ্য

আধিপত্য বিস্তারে জড়িয়ে পড়ছে অপরাধেও

স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল নেটওয়ার্ক পরিচালনায় সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কাই করছে না চট্টগ্রামের ক্যাবল অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো। চ্যানেল ক্রমবিন্যাস এবং নিজেদের ক্যাবলে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল প্রদর্শনে এসব প্রতিষ্ঠান প্রচলিত আইনকানুনকেই রীতিমতো বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেছে। অন্যদিকে ক্যাবল অপারেটর ব্যবসার নামে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ডিশ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে নিতে হামলা-মামলা, এমনকি হত্যার ঘটনায়ও জড়িয়ে পড়েছে সিএমসিএল, কেসিএল, এনএসসিএলসহ বিভিন্ন ক্যাবল অপারেটর। সরকারি কোনো অনুমোদন ছাড়াই ইপিজেড পতেঙ্গা থানা এলাকায় চলছে অবৈধ ক্যাবল ব্যবসা।

চ্যানেল বিন্যাসে বিপুল বাণিজ্য
জানা যায়, নতুন চ্যানেল ক্রমবিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের ক্যাবল অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো লাখ লাখ টাকা দাবি করে আসছে টিভি চ্যানেলগুলোর কাছ থেকে। বিশেষ করে ক্যাবল অপারেটর সিএমসিএলের হাতে জিম্মি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো। ডোনেশনের নামে চাঁদা নিয়ে তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো চ্যানেলের ক্রমবিন্যাস করে থাকে। লাইনে চ্যানেল উঠানোর ক্ষেত্রে নগদ টাকা ছাড়াও টিভি মনিটর, অফিস ডেকোরেশনসহ বিভিন্ন অনৈতিক আবদার করে অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো।

ক্যাবল অপারেটরদের মধ্যে চট্টগ্রাম মাল্টিমিডিয়া লিমিটেডের (সিএমসিএল) বিরুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পাওয়া যায়। ক্রমবিন্যাসে অন্তর্ভুক্তির নামে টিভি চ্যানেলের আঞ্চলিক অফিসগুলোর কাছ থেকে টাকা দাবি ও ক্রমবিন্যাসে চরম অনিয়ম করার সিএমসিএলের বিরুদ্ধেই বেশি। চাঁদার পরিমাণের ওপর নির্ভর করেই চ্যানেলের ইচ্ছেমতো ক্রমবিন্যাস করে প্রতিষ্ঠানটি—এমন অভিযোগ শুরু থেকেই।

সরকারি চ্যানেলের পর সম্প্রচারে তারিখ অনুযায়ী ক্রমবিন্যাস করার জন্য গত ৯ মে কোয়াব ও অ্যাটকোকে পত্র দেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রাজিয়া সুলতানা। সম্প্রচারের তারিখ অনুসারে চ্যানেলের ক্রমবিন্যাস হবে এভাবে- এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই, ইটিভি, এনটিভি, আরটিভি, বৈশাখী টিভি, বাংলাভিশন টিভি, দেশ টিভি, মাই টিভি, এনটিএন নিউজ, মোহনা টিভি, বিজয় টিভি, সময় টিভি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি, মাছরাঙ্গা টিভি, চ্যানেল নাইন, চ্যানেল ২৪, গাজী টিভি, চ্যানেল ৭১, এশিয়ান টিভি, এসএ টিভি, গানবাংলা টিভি, যমুনা টিভি, দীপ্ত টিভি, ডিবিসি টিভি, নিউজ ২৪, বাংলা টিভি, দুরন্ত টিভি, নাগরিক টিভি।

দুই খুন, জড়িয়ে পড়ছে অপরাধেও
বিভিন্ন এলাকায় ক্যাবল অপারেটর কোম্পানিগুলোর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটছে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সিএমসিএলের ফিড অপারেটরদের সঙ্গে ডিশ ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রায়ই ঘটে সংঘর্ষের ঘটনা। এসব সংঘর্ষে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হয়। আগ্রাবাদ, দেওয়ানহাট, আকবরশাহ বিশ্বকলোনি এবং চকবাজারে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় লাইন দখল করতে গিয়ে সিএমসিএলের সঙ্গে স্থানীয় ক্যাবল অপারেটরদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। আগ্রাবাদ মুহুরীপাড়া এলাকায় আধিপত্য ও লাইন দখল করতে গিয়ে ২০১০ সালে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয় চিটাগং ক্যাবলের (কেসিএল) ম্যানেজার আবু তাহের দুলালকে। সংর্ঘষের পর ব্যবসা বন্ধ করে দেয় কেসিএল। পরে এর নিয়ন্ত্রণ নেয় সিএমসিএল। এছাড়া চকবাজারে লাইন দখল করতে গিয়ে খুন করা হয় যুবলীগ নেতা ফরিদকে।

প্রশাসনের জালে সিএমসিএল
অবশেষে প্রশাসনের জালে আটকা পড়েছে সিএমসিএল। আইন লঙ্গন ও চ্যানেলের ক্রমবিন্যাসে অনিয়ম করার অপরাধে প্রতিষ্ঠানটিকে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ক্যাবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন-২০০৬ এর ধারা ১৬ মোতাবেক বেসরকারি ক্যাবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারি চ্যানেলসমূহ প্রথমদিকে রাখতে হবে। এছাড়া তথ্য মন্ত্রণালয় ও কোয়াব (ক্যাবল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) এর আলোচনার ভিত্তিতে অ্যাটকো (অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স) কর্তৃক প্রদত্ত বেসরকারি চ্যানেলসমূহ, এরপর সম্প্রচারের তারিখ (ডেট অব অন এয়ার) মোতাবেক ক্রমবিন্যাসভাবে পরিচালনা করতে হবে। এছাড়া এ আইনের ১৯ ধারা মোতাবেক বিদেশি চ্যানেলে বাংলাদেশী পণ্যের বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে হবে। এ ক্রমবিন্যাস সেটআপের জন্য বেসরকারি ক্যাবল অপারেটরদের গত ৩০ জুন পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল।

বিষয়টি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য সোমবার (১ জুলাই) মহানগরীতে অভিযান চালায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। নগরীতে তিনটি ক্যাবল অপারেটর কোম্পানিতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো হয়। অভিযানে ক্যাবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন-২০০৬ লঙ্ঘন ও ক্রমবিন্যাস ঠিক না রাখার অভিযোগে আগ্রাবাদের চট্টগ্রাম মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড (সিএমসিএল) এবং বন্দরটিলার নিউ স্টার ক্যাবেল লিমিটেডকে (এনএসসিএল) ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানভীর ফরহাদ শামীম।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানভীর ফরহাদ শামীম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকার নির্ধারিত চ্যানেল ক্রমবিন্যাস ঠিক আছে কিনা এবং বিদেশি চ্যানেলে বাংলাদেশি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য নগরীতে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে আগ্রাবাদের সিএমসিএলে ক্রমবিন্যাস ঠিক না রাখার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সিএমসিএলকে জরিমানা করে প্রাথমিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে।’

লাইলে চ্যানেল অন্তর্ভুক্ত করতে সিএমসিএলের চাঁদা দাবি প্রসঙ্গে তানভীর ফরহাদ শামীম বলেন, ‘ভবিষ্যতে এ ধরনের অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

‘কেউ টাকা দিয়ে থাকলে…’
লাইনে চ্যানেল অন্তর্ভুক্ত করতে ঘুষ দাবির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিএমসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচালক নিজাম উদ্দিন মাসুদ প্রথমে বিষয় অস্বীকার করে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা মিথ্যা কথা। প্রমাণ দিতে বলেন।’ পরে তিনি আবার বলেন, ‘কেউ টাকা দিয়ে থাকলে সে তার স্বার্থেই টাকা দিয়েছে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!