চট্টগ্রামে ঝাড়ফুঁকেই চলে জন্ডিস হেপাটাইটিস সারানোর চিকিৎসা

কবিরাজের পেছনে ছুটে জন্ডিস ছড়ায় লিভারেও

মা ও নানীর সঙ্গে ১০ বছরের রায়ান থাকে চট্টগ্রাম নগরীর আসকারাবাদে। রায়ানের চোখটা হঠাৎ হলুদ, কয়দিন ধরে কিছুই খেতে পারে না। শরীরটা ভীষণ দুর্বল। কিছু খেতে গেলেই বমি হয়। রায়ানের নানী নাতিকে নিয়ে নগরীর দেওয়ানহাটের ধনিয়ালাপাড়া যান জন্ডিসের ‘চিকিৎসা’ করাতে। ‘লিভার খিলা’ নামের এক অদ্ভূত চিকিৎসাপদ্ধতি আর গোসল করালে রায়ান সুস্থ হয়ে উঠবে বলে তার নানীর ধারণা। সেই দাওয়াই নিয়ে নানী আরও ‘উন্নত চিকিৎসা’র জন্য
সেখান থেকে রায়ানকে নিয়ে যান বহদ্দারহাট ফরিদারপাড়ার এক হুজুরের কাছে। সেই হুজুর রায়ানকে ঝাঁড়ফুক দেন। কয়দিনের এসব ঘোরাঘুরিতে রায়ানের শরীরটা হয়ে যায় আরও বেশি খারাপ। কথা বলতে বলতে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানান, ১০ বছরের ছেলেটির জন্ডিস ছড়িয়ে পড়েছে লিভারেও।

রায়ানের নানী জোবেদা বেগমই শুধু নন, জন্ডিসের গোসল কিংবা ‘জন্ডিস কিউরে’ রোগ ভালো হয়— এখনও এমন ধারণা রয়েছে শহরবাসী অনেকেরই। আর তাদের এই বিশ্বাসকে পুঁজি করে কিছু প্রতারক জন্ডিসের চিকিৎসার নামে চালিয়ে যাচ্ছে অপচিকিৎসা। অনেক সময় জীবন দিয়েই যার মূল্য দিতে হচ্ছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ নগরীর বিভিন্ন ক্লিনিকে ইতিপূর্বে ভর্তি হওয়া লিভার সিরোসিসসহ লিভারের অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীর কেস হিস্ট্রিতে দেখা গেছে এসব অপচিকিৎসার প্রভাব। চিকিৎসক বিশেষজ্ঞরা বলছেন— এসব অপচিকিৎসার ধারেকাছেও নয়, জন্ডিসের লক্ষণ দেখা দিলেই দেখাতে হবে রেজিস্টার্ড ডাক্তারকে। হেপাটাইটিস বি-এর টিকা দিতে হবে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে। যদিও ওই টিকা ব্যয়বহুল ও সচেতনতা না থাকায় এখনও মানুষ অন্ধবিশ্বাসকে পুঁজি করে ফকির-কবিরাজের কাছে ছুটছেন।

চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর বড়পোলে প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগে থেকে রফিক মন্ডল শুরু করেন জন্ডিসের ‘চিকিৎসা’। তার এই ‘চিকিৎসা’র উপকরণ— সরিষার তেল, দুর্বা ঘাস, আর কচুপাতা। সবগুলো উপকরণ একটি বেতের তৈরি থালায় নিয়ে রোগীর মাথায় ঘষতে থাকেন আর বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়েন। মন্ত্র শেষে রোগীর শরীরে ফুঁ দেন রফিক মন্ডল কবিরাজ। পরে তাদের হাতে ওষুধ হিসেবে তুলে দেন ৫০ টাকা মূল্যের ছয়টি ‘পুরিয়া’।

রফিক মন্ডল বললেন, ‘স্বপ্নে আমি এই চিকিৎসাপদ্ধতি পেয়েছি। ১৭ বছর ধরে এই পদ্ধতিতে জন্ডিসের চিকিৎসা করে যাচ্ছি।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের লিভার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ‘লিভার কেয়ার গ্রুপ’-এর সভাপতি ডা. আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, বাংলাদেশের শতকরা ১ ভাগ লোক হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের বাহক। যাদের অধিকাংশই জানেন না তারা এই রোগে ভুগছেন। হেপাটাইটিস-বি ও সি ভাইরাসজনিত ‘ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদী’ হেপাটাইটিসে আক্রান্ত রোগীদের বেশিরভাগেরই কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ থাকে না। কারও কারও ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো হল— অবসাদ, ক্ষুধামন্দা, জ্বরজ্বর ভাব, শরীর শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। উপসর্গবিহীন এসব রোগী নিজের অজান্তেই রোগটি অন্যের শরীরে ছড়ান।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জামান বলেন, জন্ডিস হলে রক্তে বিলিরুবিন বেড়ে যায়। লিভারে সমস্যা হলে কিংবা পাথর হলে, অবস্ট্রাকটিস জন্ডিস বা বাধাগ্রস্ত জন্ডিস হয়। জন্ডিসের প্রকারভেদ নিয়ে তিনি বলেন, হেপাটাইটিস-এ সাধারণত মানুষের বেশি হয়। তবে এখন বেশি হচ্ছে হেপাটাইসি-বি। ব্লাড ট্রান্সফিউশনসহ অনান্য কারণে হচ্ছে সি ও ডি। মূলত তিনটি পরীক্ষা করে সাধারণ জন্ডিস শনাক্ত করা যায়। এগুলো হচ্ছে এস.বিলিরুবিন, এস.এসজিপিটি এবং এস.এসজিওটি পরীক্ষা।

চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডা. জামান বলেন, ‘ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হেপাটাইসিস-বি প্রতিরোধক টিকা দিতে হবে। সাধারণ জন্ডিস বা হেপাটাইটিস-এ হলে পরিপূর্ণ বিশ্রাম ও রেজিস্টার্ড ফিজিশিয়ান চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হতেই হবে।’

কিন্তু দেখা গেছে, চট্টগ্রামে যারা জন্ডিসের অপচিকিৎসায় জড়িত, তাদের কথিত চিকিৎসাপ্রণালী সম্পূর্ণ ভিন্ন। নগরীর দেওয়ানহাট ধনিয়ালাপাড়ায় মীরবাড়ির সেকান্দার নামে এক কথিত কবিরাজ রয়েছেন। জন্ডিসের চিকিৎসার জন্য তিনি রোগীদের লেবু আর চুন নিয়ে যেতে বলেন। পর পর তিনদিন যেতে হয় তার কাছে। প্রতিবার তাকে দিতে হয় ৫০ টাকা। লেবু চুনের সাথে মিশিয়ে সেই পানি রোগীর মাথায় ঢেলে গোসল করিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় সেকান্দারের ‘চিকিৎসা’। সাথে করেন ঝাঁড়ফুকও। এভাবে তিনদিন গোসল করিয়ে জন্ডিসের ‘চিকিৎসা’ দেন কথিত এই কবিরাজ।

অন্যভাবে জন্ডিসের অপচিকিৎসা চলে ‘লিভার খিলা’য় করে। ‘লিভার খিলানো’র ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কবিরাজ সেকান্দার বলেন, প্রথমে রোগীর নিজের হাত ও পায়ের ২০টি আঙ্গুলের নখ কাগজে মুড়িয়ে তাকে দিতে হয়। কিছু বেগুন ছোট করে কেটে ভেতরে ঢুকিয়ে রশি দিয়ে বেঁধে দিতে হয়। এরপর তিনি দোয়া পড়ে নখগুলো বেগুনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। বাড়িতে গিয়ে বেগুনটি মাটির চুলার পাশে সামান্য গর্ত করে গুঁজে রাখতে হয় রোগীকে। কবিরাজের ভাষ্যমতে, চুলার আগুনে বেগুন পুড়ে গেলে লিভারও তখন রোগীর পরিস্কার হয়ে যায়।

চট্টগ্রামের চাক্তাই চামড়ার গুদামের পাশে ‘জন্ডিসের ডাক্তার’ তেজেন্দ্র লাল ধরের নাম বেশ পরিচিত। প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ লোক জন্ডিসের ওষুধ নিতে সেখানে যায়। তেজেন্দ্র লাল ১৯৯৯ সালে মারা যাওয়ার পর তার ছেলে ডা. প্রভাত কুমার ধর ও সহকারী চন্দন দাশ জন্ডিসের ওষুধ দেন। তাদের দেওয়া এক লিফলেটে দেখা গেছে, সেখানে অল্প টাকায় কম সময়ে আরোগ্য হয়— হাফ কোর্স ২০ টাকা, ফুল কোর্স ৬০ টাকা। হেপাটাইটিস-বি’র জন্য তিন মাসের কোর্সে চিকিৎসা দেওয়া হয় এখানে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামে এম আলাউদ্দিন নামের আরেক ‘ডাক্তার’ দোকানে দোকানে গিয়ে বিক্রির জন্য ওষুধ বিলি করেন। তিনি নিজেই ওই ‘ওষুধের’ প্রস্তুতকারক। বিভিন্ন ফার্মেসিতে সরবরাহ করা তার ‘জন্ডিস কিউরে’ বোতলের গায়ে লেখা আছে জন্ডিস, যকৃতের পীড়া, ক্ষুধামন্দা, রক্তহীনতা, দুর্বলতায় কার্যকরী এই ওষুধ। ওষুধের সেবনপ্রণালীতে বয়সভেদে কয় ফোটা খাবে তার উল্লেখ রয়েছে। ওষুধের প্রস্তুতকারক কোম্পানির নাম হিসেবে রয়েছে— তামান্না মার্কেটিং কো. চট্টগ্রাম।

চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, চট্টগ্রাম শহরে জন্ডিসের চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা দিচ্ছে— এমন অন্তত শ’দেড়েক ‘চিকিৎসকের’ কথিত চিকিৎসা নিয়ে পরবর্তীতে হেপাটাইটিস ‘বি’ ছাড়াও ‘সি’ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৩, ১৪ ও ১৬ নং ওয়ার্ডে হেপাটাইসিস ‘বি’ ছাড়াও ‘এ’ ও ‘সি’ রোগীর সংখ্যা কম নয়। সাম্প্রতিক সময়ের এক অনুসন্ধানে শুধুমাত্র ১৪ নং ওয়ার্ডেই ২৫ জনেরও বেশি রোগী ভর্তি ছিলেন এসব রোগে।

চিকিৎসক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আম গাছের ছাল চুনের সাথে মেশালে হলুদ রঙ বের হয়। এ পদ্ধতিতে গা থেকে মূলত হলুদ পানিই বের করছে এই অপচিকিৎসকরা।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৬ নং মেডিসিন বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. তামান্না বলেন, জন্ডিসের প্রথম ও প্রধান চিকিৎসা ওয়েট এন্ড সি। ক্ষতিকারক খাওয়াদাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। অ্যালোপ্যাথিক শাস্ত্রে অলটারনেটিভ মেডিসিন হিসেবে হোমিওপ্যাথি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাপ্রণালী থাকলেও সেই ওষুধের প্রস্তুতপ্রণালী রোগীকে জানাতে হবে। সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে চিকিৎসার আগে ও পরে বিলিরুবিন পরীক্ষা করানো আর পর্যাপ্ত বিশ্রামে থাকা।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!