চট্টগ্রামে চেয়ারম্যানের অবাক কাণ্ড, একজনকে ৫ রকমের ওয়ারিশ সনদ!

একই নারীকে পাঁচ পাঁচটি ওয়ারিশ সনদ দেওয়ার অভিযোগ ওঠেছে চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। নারী এক, কিন্তু পাঁচ-পাঁচটি ওয়ারিশ সনদ পাঁচ রকমের। এতে ইউপি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব-কর্তব্য নিয়েও উঠেছে গুরুতর প্রশ্ন।

চট্টগ্রামে চেয়ারম্যানের অবাক কাণ্ড, একজনকে ৫ রকমের ওয়ারিশ সনদ! 1

যে নারীর ওয়ারিশ সনদ দেওয়া নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে তার নাম আমেনা খাতুন। বর্তমানে মৃত। স্বামীর নাম মৃত সেকান্দর আহমদ। বাড়ি কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ইছানগর গ্রামের ৯নং ওয়ার্ডে।

জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর ইউপি চেয়ারম্যান ছাবের আহমদের ইস্যু করা মৃত্যু সনদপত্র অনুসারে আমেনা খাতুন মারা যান ১৯৯৫ সালের ৮ মে। ওই সময় ইউপি সদস্য ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। তিনি মৃত্যুর সনদে সুপারিশ করেন। মৃত্যুকালে আমেনা খাতুনের বয়স ছিলো ৮০ বছর।

এদিকে প্রতিবেদকের হাতে আসা পাঁচটি ওয়ারিশ সনদের ছায়াকপির তথ্য থেকে জানা যায়, আমেনা খাতুনকে সর্বপ্রথম ওয়ারিশ সনদ দেন চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সালাউদ্দীন আহমদ চৌধুরী। তিনি ২০০৮ সালের ৩০ আগস্ট ওয়ারিশান সনদটি ইস্যু করেন।

ওই ওয়ারিশ সনদে লেখা আমেনা খাতুন মৃত্যুকালে ওয়ারিশ হিসেবে জীবিত রেখে যান যথাক্রমে ছিদ্দিক আহমদ (পুত্র, বর্তমানে মৃত), শাহজাহান কবির (পুত্র) এবং রওশান আরা বেগমকে (কন্যা)। তারা দুজন ‘জীবিত’ বলে মন্তব্যের কলামে লেখা ছিল। ওই ওয়ারিশ সনদে আমেনা খাতুনের পুত্র মো. মহসীনের নাম জীবিত বা মৃত কোন জায়গায় উল্লেখ করা হয়নি। ফলে তিনজন ওয়ারিশ দেখানো হয়।

একই নারীর দ্বিতীয় ওয়ারিশ দেওয়া হয় ২০১৩ সালের ৩০ নভেম্বর। ১নং (খ) চরপাথরঘাটা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ১১২০/২০১৩ নম্বর স্মারকে চেয়ারম্যান ছাবের আহমদ সনদে স্বাক্ষর করেন পরের মাসের ৭ তারিখ। ওই সনদ ইস্যু হয় নভেম্বর মাসে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে চেয়ারম্যান স্বাক্ষর করেন ডিসেম্বরে।

ওই সনদে আমেনা খাতুনের ওয়ারিশ হিসেবে দেখানো হয় ৫ জনের নাম। তাতে নতুন করে সংযুক্ত হন আমেনা খাতুনের স্বামী সেকান্দর আহমদ ও পুত্র উকিল মো. মহসীন। পাশে উল্লেখ করা হয়, মাতা জীবিত থাকা অবস্থায় মহসীন মৃত্যুবরণ করেন। যা সঠিক বলে স্থানীয়রা জানান। সনদে বিশেষ দ্রষ্টব্য দিয়ে লেখা আছে— ‘অত্র ওয়ারিশান সনদপত্রে ভুল তথ্য থাকলে উক্ত সনদ বাতিল বলে গণ্য হবে।’ এই কথাটির ফাঁকফোকর দিয়েই আইনি মারপ্যাঁচ থেকে রক্ষার যত কৌশল অবলম্বন করে চেয়ারম্যানেরা ইচ্ছেমতো সনদ দিচ্ছেন বলে অভিযােগ রয়েছে।

একই বছরের ডিসেম্বর মাসে আবারও ওই নারীর তৃতীয়তম ওয়ারিশ সনদ দেন চরপাথরঘাটার ইউপি চেয়ারম্যান ছাবের আহমদ। যার স্মারক নম্বর-১১২৬/২০১৩। এই ওয়ারিশ সনদ আরো জটিল। এবারে সনদে আমেনা খাতুনের ওয়ারিশ হলেন মোট ১১ জন। এতে নতুন করে আমেনা খাতুনের ওয়ারিশ হিসেবে যুক্ত হলেন পুত্রবধূ হোসনে আরা বেগম ও তার ৭ জন ছেলে-মেয়ে।

সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবার চতুর্থ ওয়ারিশ সনদও প্রদান করেন। ২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারি। তাতে স্বাক্ষরও করেন ছাবের আহমদ। সনদটিতে দেখা যায়, পূর্বের তিনটি সনদ কম্পিউটারে লেখা ছিল। এর মধ্যে দুটি সনদে স্মারক নম্বর ছিলো। চতুর্থ সনদটি আবার হাতের লেখা ও স্মারক নম্বর নেই। সনদে আমেনা খাতুনের ওয়ারিশ হিসেবে লেখা হল ৪ জন। তিন পুত্র ও এক কণ্যা। এরা হলেন ছিদ্দিক আহমদ (মৃত), উকিল মো. মহসীন (মৃত), শাহজাহান কবির (জীবিত) ও রওশন আরা বেগম (মৃত)।

এরমধ্যে গত ২১ নভেম্বর এডভোকেট মহসীনের ছেলে আহমেদ আসাদুল আমিন চরপাথরঘাটা চেয়ারম্যানের কাছে একটি আবেদন করেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, একই ব্যক্তিনীর নামে ইস্যুকৃত অসঙ্গতিপূর্ণ চারটি ওয়ারিশ সনদের মধ্যে ত্রুটিপূর্ণ সনদ বাতিলপূর্বক সঠিক প্রত্যয়ন দেওয়ার। ইউপি চেয়ারম্যান বিষয়টি স্থানীয় মেম্বার মোহাম্মদ সুমনকে তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন।

আবেদনের ২ মাস ১৭ দিন পর যাচাই বাছাই ও সময়সাপেক্ষে বিবেচনা করে গত ৩০ জানুয়ারি চরপাথরঘাটা ইউপি ২৪৯/২৩ স্মারকমূলে সর্বশেষ ওয়ারিশ সনদ প্রদান করেন। এতে আমেনা খাতুন মৃত্যুকালে ওয়ারিশ রেখে যান ৪ জন।

সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, মৃত্যুকালে আদৌ আমেনা খাতুন নামে ওই নারী কতজন ওয়ারিশ রেখে যান? কেননা ব্যক্তিনী এক কিন্তু এক ওয়ারিশ সনদে ৩ জন, আরেক ওয়ারিশ সনদে ৫ জন, অন্য ওয়ারিশ সনদে ১১ জন ও সর্বশেষ ওয়ারিশ সনদ দুটিতেই ৪ জন।

এ ঘটনায় স্বয়ং ইউপি চেয়ারম্যান নিজেই বিভ্রান্তিতে পড়েছিলেন। এসব ভিন্ন ভিন্ন ওয়ারিশ সনদ কারা নিলেন? ধারণা করা হচ্ছে, হয়তো কোন না কোন ওয়ারিশের ছেলে-মেয়েরা এসব সনদ সংগ্রহ করে নিজেদের সুবিধার্থে মামলা মোকাদ্দমা ও ভূমি অফিসে যোগান দিয়েছেন।

জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট এলাকার বর্তমান ইউপি সদস্য মোহাম্মদ সুমন বলেন, ‘চেয়ারম্যানের নির্দেশে মরহুমা আমেনা খাতুনের ওয়ারিশদের খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, প্রকৃতপক্ষে প্রয়াত আমেনা খাতুনের ওয়ারিশ হলো ৪ জন। এর মধ্যে মাতার পূর্বে এডভোকেট মহসীন মারা যান।’

অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন জানান, ‘অনেকে একই ব্যক্তির ওয়ারিশ সনদের প্রতিলিপি তৈরি করে সেখানে ওয়ারিশের সংখ্যা কমিয়ে আরেকটি সনদ করে সুবিধা নেন। আবার অনেকে সরকারিভাবে অধিগ্রহণ করা জমির টাকা নেওয়া কিংবা জমির অংশ কম বেশ করতে বিভিন্ন নামজারি বা মামলায় এসব করে থাকেন। যা দণ্ডনীয় অপরাধ।’

এ বিষয়ে চরপাথরঘাটার ইউপি চেয়ারম্যান ছাবের আহমদ বলেন, ‘পূর্বে ইস্যুকৃত সনদগুলো বাতিল করে ইউপি মেম্বারের তদন্ত সাপেক্ষে সর্বশেষ আমেনা খাতুনের ওয়ারিশ সনদটি প্রদান করা হয়েছে। সনদ নিয়ে কোন জটিলতা সৃষ্টি হলে পুনরায় তাও বাতিল করা হবে।’ কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামুনুর রশীদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

চট্টগ্রাম স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক (অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক) বদিউল আলম বলেন, ‘কেউ এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে আসেনি। যদিও একই ব্যক্তিকে একেক ধরনের সনদ দেওয়া সমীচীন নয়।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!