চট্টগ্রামে চিন্তা বাড়াচ্ছে বাতজ্বর, মনগড়া চিকিৎসায় বাড়ছে হৃদরোগ

চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি শিশুদের ৪২ ভাগেরই বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ

চট্টগ্রামে বাতজ্বরের চিকিৎসায় নানারকম বিভ্রান্তিতে পড়ছেন রোগীরা। অনেক রোগী ব্যাথার ট্যাবলেট খেয়ে ব্যাথা নিরাময়ের চেষ্টা করেন। এতে বাতজ্বর ততোদিনে হৃদরোগে পরিণত হয়ে যায়। শুধুমাত্র না জানার জন্যই বাতজ্বরে আক্রান্ত হয়ে অনেক শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৯ নম্বর হৃদরোগ বিভাগ ও ১২ নং শিশুরোগ বিভাগে এমন শিশু ও বয়স্ক রোগীর খোঁজ মিলেছে, প্রাথমিক অবস্থায় যাদের বাতজ্বর হয়েছিল।

অন্যদিকে শিশুরোগ বিভাগে ভর্তি হওয়া শিশুর মধ্যে শতকরা ৪২ ভাগই বাতজ্বরজনিত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আসে। আর শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ হৃদরোগীর অস্ত্রোপচারের কারণ হলো বাতজ্বরজনিত সমস্যা। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, সঠিক চিকিৎসায় এ রোগ ভালো হয়। তাই রোগীদের বাতজ্বর নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করারও পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রামের অনেক লোক এখনও বাতজ্বর সম্পর্কে সচেতন নন। আবার অনেকে জানেনও না বাতজ্বর আসলে কী? গ্রুপ এ-বিটা হোমোলাইটিক স্টেপটোকক্কাস নামের ব্যাকটেরিয়া গলায় প্রদাহের সৃষ্টি করলে বাতজ্বর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবু বাতের ব্যাথা ও বাতজ্বর সম্পূর্ণ আলাদা। বাতজ্বরের ক্ষেত্রে গলায় নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া আক্রমণের দুই থেকে পাঁচ সপ্তাহ পর শরীরের বড় গিটে ব্যাথা শুরু হয়। সঠিক ব্যবস্থা না নিলে পরে হৃদপিণ্ডে প্রদাহের সৃষ্টি হয়। বাত জ্বরে নারী ও শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯ নং ও ১২ নং ওয়ার্ডে হৃদরোগে আক্রান্ত অর্ধশতেরও বেশি শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া যায়, যারা শুরুতে বাতজ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু অভিভাবকরা না বুঝে শিশুকে বাড়ির পাশের ডাক্তার দেখিয়ে ব্যথার ওষুধ খাইয়েছেন। বয়স্করাও ধরেছেন একই পথ।

১২ নং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন সোহাগের বাবা আমজাদ হোসেন জানান, রাসেলের বয়স ১২ বছর। ছোটবেলা থেকেই তার মাঝে মাঝেই গলা ব্যাথা করতো। গা-হাত ও পায়ে ব্যাথা করতো। ডাক্তার দেখিয়ে এন্টিবায়োটিক খাওয়ালে গলাব্যাথা কমতো। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে এ সমস্যা প্রায়ই হতে থাকে। শেষে বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে জানা যায় রাসেল বাতজ্বর সমস্যায় আক্রান্ত। রাসেলের বাবা আরও বলেন, ডাক্তার বলেছে রাসেলের হার্টে সমস্যা পাওয়া গেছে।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রণব কুমার চৌধুরী জানান, বাতজ্বরে আক্রান্ত হলে ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ শিশু-কিশোরের হৃৎপিন্ডের ভাল্ব নষ্ট হতে পারে বা অন্যান্য হৃদরোগ হতে পারে। তবে সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে বাতজ্বর ভালো হয়। সতর্কতামূলক কিছু পদক্ষেপ নিলে তা প্রতিরোধও করা যায়।

তিনি জানান, পাঁচ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের স্ট্রেপটো গলা ব্যথা সন্দেহ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করানো উচিত। এতে বাতজ্বর হওয়া থেকে শিশুরা রক্ষা পাবে।

তিনি আরও জানান, স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের স্ট্রেপটোকক্কাস নামক এক ধরনের বিশেষ শ্রেণির জীবাণু আক্রমণ করতে পারে। এর কারণে গলা ব্যথা, গিরা ব্যথা ও জ্বর হয়— যা বাতজ্বর নামে পরিচিত। সাধারণত এসব উপসর্গের চার বা পাঁচ সপ্তাহ পর বাতজ্বর দেখা দেয়। দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে কোনো চিকিৎসা না দিলেও মনে হয় যেন সেরে গেছে। অথচ কিছুদিন পর আবার দেখা দেয়। গ্রুপ ‘এ’ ব্যাকটেরিয়া হিমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাস কর্তৃক গলা ব্যথার পর ইমিউন প্রক্রিয়ায় হার্ট ও বিভিন্ন জয়েন্টে, কখনও বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, চামড়া বা শরীরের অন্যান্য অংশের ক্ষতি হয়।

তিনি আরও জানান, তবে গলা ব্যথা হলেই বাতজ্বর হবে এমন ভাবা ঠিক নয়। কেননা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাইরাসের কারণে গলা ব্যথা হয়ে থাকে। সাধারণ নিয়মে যে গলা ব্যথায় নাক ঝরে না, চোখ ঝরে না বা লাল হয় না, তার কারণ স্ট্রেপটো ব্যাকটেরিয়া। এ ছাড়া স্ট্রেপটো গলা ব্যথায় গলার পাশের গ্র্যান্ড কিছুটা বড় পাওয়া যেতে পারে, যা ধরলে ব্যথা অনুভূত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য গলা ব্যথা নাও থাকতে পারে।

প্রণব কুমার চৌধুরী জানান, সাধারণত পাঁচ থেকে ১৫ বছর বয়সের ছেলে-মেয়েদের বাতজ্বর হয়ে থাকে। তবে এই বয়সসীমার চেয়ে বড় অথবা ছোটদেরও এ রোগ হতে পারে। ঘিঞ্জি ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে থাকা শিশুদের মধ্যে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তবে বয়স ও পরিবেশের প্রভাবের বাইরে জেনেটিক কারণও আছে। একবার এ রোগ হলে বারবার এটি দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শিশুদের বাইরে শিক্ষক, শিশুপরিচর্যাকারী ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরও এ রোগে ভোগার ঝুঁকি থাকে। শিশুদের বাতজ্বরে সবচেয়ে মারাত্মক অসুবিধা হৃদযন্ত্রের প্রদাহ বা কার্ডাইটিস— যা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে হতে পারে। এর ফলে শ্বাসকষ্ট হওয়া, বুক ধড়ফড় করা এবং পায়ের পাতা ফুলে যাওয়া, কখনও বা কোনো উপসর্গ ছাড়া অনেকটা গোপন ধরনের কার্ডাইটিসে শিশু আক্রান্ত হতে পারে।

আবার গিরায় ব্যথা ও ফুলে যাওয়া বা আর্থ্রাইটিসে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বাতজ্বরের শিশুর এ লক্ষণ দেখা দিতে পারে। সচরাচর দুদিকের একই প্রকারের বড় বড় অস্থিসন্ধি যেমন পায়ের গোড়ালি, হাঁটু, কনুই, হাতের কনুুই, হাতের কবজির গিরা ফুলে যায়। এছাড়া আরও বহু রোগের কারণে শিশুদের গিরায় ব্যথা বা ফোলা দেখা যায়।

রোগের লক্ষণ দেখা দিলে প্রাথমিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে ১০ দিনের পেনিসিলিন বড়ি ও ১২ লাখ ইউনিটের একটি পেনিসিলিন ইনজেকশন দেওয়া হয়।

সাধারণত মনে করা হয় গিরায় গিরায় কিংবা হাড়ে হাড়ে ব্যথা হলে সেটা বাতজ্বরের লক্ষণ। তবে সবক্ষেত্রেই তা সঠিক নয়। ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. গোবিন্দ চন্দ্র রায় জানান, রোগীর অতীত ইতিহাস, উপসর্গ এবং অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এ রোগ নিশ্চিত করতে হয়। বাতজ্বরের কিছু মুখ্য ও কিছু গৌণ লক্ষণ রয়েছে। দুটি কিংবা একটি মুখ্য লক্ষণের সঙ্গে দুটি গৌণ লক্ষণ নিশ্চিতভাবে মিলে গেলে বাতজ্বর নির্ণয় করা যায়। তার সঙ্গে বিটা হিমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাসজনিত সংক্রমণের ইতিহাস বা প্রমাণও থাকতে হবে।

তিনি আরও জানান, রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা নিয়ে রয়েছে নানা ভ্রান্তি ও অসচেতনতা। যেমন স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে রক্তে এএসও টাইটার বৃদ্ধি পায়। অনেক সময় এটি বাড়লেই বলা হয় বাতজ্বর হয়েছে। কিন্তু এএসও টাইটার একটি সহায়ক পরীক্ষামাত্র। অন্যান্য লক্ষণ না থাকলে এর বৃদ্ধিতে কিছু আসে-যায় না। বাতজ্বর ছাড়াও এএসও টাইটার বাড়তে পারে। যেমন— স্ট্রেপটোকক্কাসজনিত কিডনি রোগ, স্কারলেট জ্বর, নিউমোনিয়া, ইরাইসেপালাস এবং যেকোনো স্ট্রেপটোকক্কাস সংক্রমণ। তাই এএসও টাইটার বেশি পেলেই আতঙ্কিত হবেন না। বাতজ্বর আছে কিনা— তা নিশ্চিত হয়ে তবেই চিকিৎসা শুরু করা জরুরি। কেননা এ রোগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি।

জানা যায়, কোনো একক রোগ লক্ষণ বা পরীক্ষা বাতজ্বর নির্ণয় নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট নয়। কোনো শিশুকে পরীক্ষা করে যদি দুটি প্রধান লক্ষণ বা একটি প্রধান লক্ষণ পাওয়া যায়, তাহলে এই শিশুর বাতজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শিশুর বাতজ্বর নির্ণয়ের এই নিয়মকে জোনস প্রণীত নির্দেশিকা বলা হয়। বাতজ্বর রোগ নির্ণয়ে এখন পর্যন্ত এই নির্দেশিকা খুবই কার্যকর। থ্রোট সোয়াব কালচার করেও বোঝা যায়।

সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানের কথা উল্লেখ করে শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ আব্দুর রাজ্জাক শিকদার জানান, প্রতি হাজারে প্রায় আটজন শিশু বাতজ্বরে ভোগে। আর বাতজ্বরজনিত কারণে দীর্ঘমেয়াদী হৃদরোগে ভোগে চারজন শিশু। উপসর্গ বুঝে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পাশাপাশি পরিস্কার পরিচ্ছন্নতাও জরুরি বলে মত দেন এই চিকিৎসক।

তিনি বলেন, এই রোগের চিকিৎসা কিছু রোগীর ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। তাই উপসর্গ চলে গেলেই এই রোগ সেরে গেছে— এমন ধারণা থেকেও সরে আসা উচিত।

এর চিকিৎসা বলতে বাতজ্বর পরবর্তী হৃদরোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকেই বোঝায়। তবে সঠিক সময়ে চিকিৎসা করালে এ রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় হয় এবং কোন ঝুঁকি থাকে না। এ ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করার ওপর জোর দিতে হবে। নিয়মিত কাউন্সেলিং ও জরিপ চালাতে হবে। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে অস্বাস্থ্যকর বা স্যাঁতসেতে পরিবেশে থাকা যাবে না। সুষম খাবার খেতে হবে এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হবে।

শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ আব্দুর রাজ্জাক শিকদার বলেন, রোগের সাথে পরিবেশ, পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্যের একটি বড় সম্পর্ক রয়েছে। ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি শিশু কিশোরদের অপুষ্টির কারণে বিশেষ করে আমিষের অভাবে বাতজ্বর হতে পারে। স্বাভাবিকের চেয়ে যেসব শিশুর ওজন ১০ শতাংশ কম তাদের এ রোগে আক্রান্তের সম্ভাবনা বেশি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!