চট্টগ্রামে চাকরির নামে ঠগবাজির নিখুঁত জালে পুলিশও ব্যবহৃত হয়েছে সমানে

থানায় হতো সত্যিকারের পুলিশ ভেরিফিকেশন

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব পরিচয়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নামে প্রতারণার অভিযোগে চট্টগ্রামে সেকান্দর আলী (৫৫) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা করতে শুধু বন্দর সচিব পদ না বরং পুলিশকেও সমানে ব্যবহার করে গেছেন এই ব্যক্তি। যাদের কাছ থেকে চাকরি দেবেন বলে টাকা নিতেন, তাদের চাকরির জন্য সত্যিকারের পুলিশ ভেরিফিকেশনও হতো— এমনটাই জানিয়েছেন প্রতারণার শিকার হওয়া এক ব্যক্তি। এই বিষয়টিই রীতিমতো অবাক করেছে পুলিশ কর্মকর্তাদের। এদিকে প্রতারণার নাটককে বিশ্বাসযোগ্য করতে সত্যি সত্যি পুলিশ ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা করার কথা প্রাথমিকভাবে স্বীকারও করে নিয়েছেন সেকান্দর। যদিও তার দেওওয়া তথ্য অনুযায়ী সেখানেও রয়েছে আরেক মস্ত জালিয়াতির উপাখ্যান।

বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) রাতে নগরীর চান্দগাঁও থেকে সেকান্দর আলী (৫৫) নামে ওই প্রতারককে গ্রেফতার করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। তার বাসা নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায়।

নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারের মুরগীহাটা লেনের চা-দোকানি আবুল কাশেম নামে একজনের অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নিজের ছেলেসহ আরও ৩ জনের চাকরির জন্য দফায় দফায় সেকান্দরকে ১৫ লাখ টাকা দিয়েছেন আবুল কাশেম।

নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারের মুরগীহাটা লেনের চায়ের দোকানদার আবুল কাশেম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, নুর মোহাম্মদ এবং নওরোজ (২৬) প্রতিদিন তার দোকানে চা খেতে আসতেন। সেকান্দরকে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব হিসেবে পরিচয় করে দেন নুর মোহাম্মদ। এভাবে ঘনিষ্ঠতার একপর্যায়ে আবুল কাশেম তার ছেলেকে চট্টগ্রাম বন্দরে একটি চাকরি দেওয়ার আবদার করেন। দুই-তিন দিন পর তারা আবার দোকানে চা খেতে গিয়ে জানায়, ১৫ লাখ টাকা দিলে কাশেমের ছেলের বন্দরে চাকরি হবে।

তাদের কথায় বিশ্বাস করে ২০১৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর রিয়াজউদ্দিন বাজারের মদিনা হোটেলে বসে কাশেম তাদের হাতে সাড়ে তিন লাখ টাকা দেন। ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি একই স্থানে বসে আরও সাড়ে ১১ লাখ টাকা দেন।

এর মধ্যে নিয়ম অনুযায়ী তাদের পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়েছে জানিয়ে প্রতারণার শিকার আবুল কাশেম বলেন, ‘মোট ৯ লাখ টাকা দেওয়ার পর সেকান্দর পুলিশ ভেরিফিকেশনের কথা বলেন। বলেন কুমিল্লার কোতোয়ালী থানায় পুলিশ ভেরিফিকেশন হবে। আমার ছেলেসহ বাকি ৩ জন এরপর সেখানে যান। একজন অফিসার ভেরিফিকেশনের জন্য বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। এমনকি কোন্ পদে চাকরির আবেদন করেছে সেটাও জিজ্ঞাসা করেন।’

আবুল কাশেম বলেন, ‘কিন্তু ভেরিফিকেশনের সেই রিপোর্ট এসেছে কিনা আমি জানি না। এছাড়া তাদের মেডিকেল রিপোর্টও করিয়েছে সেকান্দর। সাগরিকা স্টেডিয়ামের ভেতরে নিয়ে গিয়ে মেডিকেল রিপোর্ট করার কথা বলেছে সে। তারাও সেখানে গিয়ে তার কথামত মেডিকেল রিপোর্ট করে আসছে।’

চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজাম উদ্দিন বলেন, ‘সেকান্দরকে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব সাজিয়ে গত পাঁচ-সাত বছর ধরে তারা প্রতারণা করে আসছিল। চাকরি দেওয়ার নামে তারা অগ্রিম টাকা নেয়। ইন্টারনেট থেকে ভুয়া নিয়োগপত্র প্রিন্ট করিয়ে দেয়। আবার ভুয়া পুলিশ ভেরিফিকেশনের চাহিদাপত্র ডাকযোগে থানায় পাঠায়। পুলিশও এই প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে বর্ণিত ঠিকানায় ভেরিফিকেশনের জন্য গেছে— এমন ঘটনাও আছে।’

তবে এমন ভুয়া কাগজপত্র বা চাহিদায় কিভাবে পুলিশ ভেরিফিকেশন করা সম্ভব— এটি নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই ঘটনায় সেকান্দর আলীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালী থানার উপ পরিদর্শক মেহেদী হাসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রেও জালিয়াতি করেছে বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে সেকান্দর। সে বলেছে জাল নথি তৈরি করে সেগুলো পাঠাতো থানাগুলোতে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি।’

পুলিশ জানিয়েছে, বন্দরে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে সেকান্দারসহ ৩ জনের এই চক্র ৭ জনের কাছ থেকে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে শুভ্র প্রকাশ সাহার কাছ থেকে ছয় লাখ ৫০ হাজার টাকা, সুমা রানী বণিকের কাছ থেকে ছয় লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং গৌরব চন্দ্র সূত্রধরের কাছ থেকে সাত লাখ টাকা আত্মসাৎ করার কথা এখন পর্যন্ত জানা গেছে।

তবে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা কোনভাবেই হওয়ার কথা না। কারণ কেউ ডাকযোগে চাহিদাপত্র পাঠিয়ে দিলেই ভেরিফিকেশন করা হয়— বিষয়টা এমন না। এমনটা হওয়ার সুযোগ নেই।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!