চট্টগ্রামে গর্ভবতী নারীদের বিপদ বাড়ছে করোনায়, মারা যাচ্ছেন বেশিরভাগই

গর্ভপাত ঘটিয়েও অনেক মাকে বাঁচানো যাচ্ছে না

চট্টগ্রামের একে খান মোড়ের বাসিন্দা জেসমিন আকতারের পেটে যখন ছয় মাসের বাচ্চা, গত ২৪ জুলাই তার নমুনায় করোনার জীবাণু শনাক্ত হয়। অবস্থা একটু খারাপের দিকে এগোতে থাকলে ৩০ জুলাই তাকে ভর্তি করানো হয় চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। ৩৫ বছর বয়সী এই গৃহিণীর শারীরিক অবস্থার দ্রুতই অবনতি হতে থাকলে মাত্র একদিন পর ১ আগস্ট তাকে নিয়ে যাওয়া হয় আইসিইউতে। কিন্তু সেখানে ক্রমেই তার অক্সিজেন লেভেল নিচে নেমে যাচ্ছিল। প্রথম দিন ২০ লিটার গতিতে অক্সিজেন দেওয়া হলেও তৃতীয় দিনেই তাকে দিতে হল ৬৫ লিটার গতির অক্সিজেন। চতুর্থ দিনেই সেটা ওঠে যায় ৮০ লিটারে।

ডাক্তাররা আগের অভিজ্ঞতা তখনই বুঝতে পারছিলেন, মা হতে যাওয়া এই নারীকে বাঁচানো কঠিন হবে। শেষ চেষ্টা হিসেবে বুধবার (৪ আগস্ট) রাতে পেটের বাচ্চা বের করে নেওয়া বা অ্যাবরশনের চেষ্টা করলেন ডাক্তাররা। ৫ ঘন্টার সেই চেষ্টা বিফল হওয়ার পর বৃহস্পতিবার (৫ আগস্ট) সকালে আবার চললো অ্যাবরশনের চেষ্টা। সেই দিনটিতে সত্যিকার অর্থেই চলছিল জীবনমৃত্যুর যুদ্ধ। জেসমিন আকতারকে সেদিন দেওয়া হচ্ছিল ৯০ লিটার গতির অক্সিজেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ওইদিন রাত ১২টার দিকে মারা যান তিনি।

একা জেসমিন আকতারই শুধু নন, গত অন্তত একমাসের একাধিক ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে— চট্টগ্রামে গর্ভবতী নারীদের জন্য ভয়ংকর বিপদ বয়ে আনছে করোনাভাইরাস। শেষ চেষ্টা হিসেবে পেটে থাকা বাচ্চাকে অ্যাবরশন বা গর্ভপাত করিয়েও মাকে বাঁচানো যাচ্ছে না। চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে হঠাৎ করে এমন রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায়। বাংলাদেশে গর্ভপাত বেআইনি ও অপরাধযোগ্য হলেও শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শে মায়ের জীবন বাঁচাতে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে গর্ভপাতের সুযোগ রয়েছে।

পাঁচ মাসের গর্ভবতী নিশি (ছদ্মনাম) করোনা আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৫ দিন ধরে। অবস্থার অবনতি হলে ৩৮ বছর বয়সী নিশিকে বাঁচাতে তার পেটের ৫ মাসের বাচ্চাকে অ্যাবরশন বা গর্ভপাত করিয়ে নেওয়া হয়। তবে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি নিশিকে। বৃহস্পতিবার (৫ আগস্ট) সকালে ওই হাসপাতালে আইসিইউ ওয়ার্ডে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় মারা যান নিশি। হাসপাতাল ও রোগীর নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন ওই রোগীর স্বজন ও হাসপাতালটির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র।

করোনার শুরুতে দুই একজন গর্ভবতী নারী পেটে বাচ্চা নিয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটলেও প্রথম দফায় গর্ভবতী নারীদের করোনায় আক্রান্তের হার ছিল কম। তবে চলতি বছরের জুলাই থেকে শুরু হওয়া করোনার নতুন ঢেউয়ে প্রচুর গর্ভবতী নারী করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে রোগী বাঁচাতে প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা রোগীদের অ্যাবরশন বা গর্ভপাত করিয়েও মাকে বাঁচানো প্রায়ই সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা।

এক্ষেত্রে তরুণদের ভ্যাকসিন না পাওয়াকেই অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করছেন চিকিৎসকরা। সচেতনতার পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে গর্ভবতী নারীদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরামর্শও দিচ্ছেন তারা।

অ্যাবরশন বা গর্ভপাত ঘটিয়ে করোনা আক্রান্ত গর্ভবতী নারীকে বাঁচানোর চেষ্টা চট্টগ্রামে এটিই প্রথম নয়। কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালেও এমন একটি চেষ্টা করা হয়েছিল। খুব ক্রিটিকাল অবস্থায় চলে যাওয়া রোগীকে বাঁচানোর সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে ৪ মাসের গর্ভবতী ওই নারীর বাচ্চা অ্যাবরশন করিয়ে নিলেও শেষ পর্যন্ত বাঁচানো সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির গাইনি কনসালটেন্ট ডা. রওশন আরা।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘গত বছরের (২০২০) এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা গর্ভবতী করোনা আক্রান্ত রোগী পেয়েছি সবমিলিয়ে ১০ থেকে ১২ জন। আর এই জুলাইয়ে প্রতিদিনই গড়ে আমরা দুজন করে প্যাশেন্ট ভর্তি করাচ্ছি। এদের বেশিরভাগেরই অক্সিজেন ও আইসিইউ প্রয়োজন হচ্ছে। খুব অল্পসংখ্যক রোগী পাচ্ছি যাদের অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে না। তবে আমরাও সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছি। প্রায় প্রতিদিনই সিজার হচ্ছে, নরমাল ডেলিভারি হচ্ছে।’

চট্টগ্রামের এই অন্যতম করোনা চিকিৎসা কেন্দ্রে করোনা ডেডিকেটেড গাইনি ওয়ার্ড রয়েছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (৫ আগস্ট) ওই ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন ১০ জন গর্ভবতী নারী।

গত এক মাসে চট্টগ্রামের বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালেও মোট ১২ জন কোভিড আক্রান্ত গর্ভবতী নারী ভর্তি হয়েছেন। যাদের মধ্যে দুজন নারী গর্ভে সন্তান নিয়েই মারা গেছেন। একজন মারা গেছেন সিজারিয়ান অপারেশনের পর।

হাসপাতালটির জেনারেল ম্যানেজার তালুকদার জিয়াউর রহমান শরীফ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গর্ভবতীদের মধ্যে যারা ভর্তি হচ্ছেন সবারই উচ্চমাত্রার অক্সিজেন লাগছে। অনেকের ১০০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন চাহিদা রয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা আইসিইউ বেডেই ডেলিভারি সম্পন্ন করার একটা ফুল সেটআপ রেডি করেছি।’

এবারে হঠাৎ এত পরিমাণ গর্ভবতী নারী আক্রান্ত হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের করোনা চিকিৎসা কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. অলক নন্দী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রচুর গর্ভবতী নারী আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেকে মারাও যাচ্ছেন। এরা সকলেই বয়সে তরুণ। এর বড় কারণ হচ্ছে কিছুদিন আগ পর্যন্ত আমরা তরুণদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে পারিনি। এছাড়াও গর্ভবতীদের ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতার প্রয়োজন আছে। সেখানেও অনেক ঘাটতি থেকে যায়।’

এই বিষয়ে ডা. অলক নন্দীর সাথে একমত গাইনি রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রওশন আরাও। তিনি বলেন, ‘গর্ভবতী নারীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা আমরা অনেকদিন ধরে বলছি। দুই একদিন ধরে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখলাম এই বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তও এসেছে যে গর্ভবতীদের টিকা দেওয়া হবে। এমনটা হলে বেশ ভাল হয়।’

গত জুনে এক রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের ভার্চুয়াল বেঞ্চ যেসব হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করা হয়, সেখানে গর্ভবতী নারীদের করোনা পরীক্ষার স্যাম্পল গেলে তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করার নির্দেশ দেন। গত সোমবার (২ আগস্ট) গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মায়েরা করোনার টিকা নিতে পারবেন বলে সুপারিশ করেছে করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় টিকা পরামর্শক কমিটিও দেশের অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং স্তন্যদাত্রী মায়েদের করোনার টিকা গ্রহণে কোনো বাধা নেই এবং তাদেরকে টিকা দেওয়া যেতে পারে বলে সুপারিশ করেছে। সর্বশেষ রোববার (৮ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদফতর এক নির্দেশনায় বিশেষ কিছু শর্ত মেনে অন্তঃসত্ত্বা ও ও স্তন্যদানকারী নারীদেরও করোনার টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অন্য একজন নামি চিকিৎসক বলেন, ‘করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর সন্তান জন্ম দেওয়া মায়েদের নানা ধরনের সমস্যা দেখা গেলেও নবজাতকদের সেভাবে কোনো সমস্যা দেখা যায়নি। তবে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে অনেক মায়ের গর্ভপাত হয়েছে অথবা সময়ের আগে প্রসববেদনা হয়েছে। দেখা গেছে বাচ্চার ওজন ঠিকমতো বাড়েনি।’

তিনি বলেন, ‘শেষ তিন মাসে যদি করোনা পজিটিভ হন কোনো গর্ভবতী মা, তখন তার জীবনের ঝুঁকি থাকে সবচেয়ে বেশি। কারণ স্বাভাবিক সময়ে যে ফুসফুসটা অক্সিজেন নেওয়ার জন্য প্রসারিত হয়, জরায়ু শেষ তিন মাসে বেশ বড় হয়ে যাওয়ার কারণে মাত্র তিন ভাগের প্রায় এক ভাগ ফুসফুস প্রসারিত হতে পারে। করোনা ছাড়া স্বাভাবিক সময়ে যে বাতাস তারা গ্রহণ করতে পারেন, শেষ তিন মাসে তা না পারার কারণে এমনিতেই মায়েদের শ্বাসকষ্ট হয়। তখন করোনায় আক্রান্ত হলে তা জটিল আকার ধারণ করে। এজন্য চিকিৎসকরা দ্রুত সিজারের ব্যবস্থা করে বাচ্চাটিকে আলাদা করার চেষ্টা করেন।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!