চট্টগ্রামে করোনা রোগী বাঁচানোর ম্যাজিক হতে পারে হাই ফ্লো ক্যানোলা!

পুরো চট্টগ্রাম মিলিয়ে আছে সর্বোচ্চ ২০টি, এখনই দরকার ৫০টি

ফেসবুক খুললেই চোখে পড়ে আকুতি— ‘কেউ কি একটি আইসিইউ সিটের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?’ পুরো চট্টগ্রামেই এখন অক্সিজেন সিলিন্ডার কিংবা আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) বেডের জন্য রীতিমতো হাহাকার চলছে। জীবন বাঁচাতে ঘন্টার পর ঘন্টা হাসপাতালের বারান্দায় ছোটাছুটি করেও মিলছে না একটা আইসিইউ বেড। অক্সিজেন না পেয়েও মৃত্যু হচ্ছে অনেকের। চিকিৎসকরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ করোনা রোগীদের জীবন বাঁচাতে আইসিইউর চেয়েও এই মুহূর্তে সবচেয়ে দরকারি হল হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা। চট্টগ্রামে এখনই অন্তত আরও ২০ থেকে ২৫টি হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা থাকলে সেটি দিয়েই করোনার অনেক রোগীকে বাঁচানো সম্ভব। হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা দিয়ে রোগীর শরীরে উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। যা অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে কখনোই সম্ভব নয়।

চিকিৎসকরা জানান, যখন করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত কোনো রোগীর অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৮০-এর নিচে কমতে থাকে, তখন রোগীর আইসিইউ বা ভেন্টিলেটর সাপোর্টের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে রোগীর শরীরে যত দ্রুত অক্সিজেন সরবরাহ করা প্রয়োজন, তত দ্রুত অক্সিজেন শরীরে সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। এ অক্সিজেন সরবরাহের জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা। আইসিইউ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ করোনা রোগীদের জীবন বাঁচাতে আইসিইউর চেয়ে এই মুহূর্তে সবচেয়ে দরকারি কাজটিই হল হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলার (এইচএফএনসি) মাধ্যমে রোগীর শরীরে উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহ করা।

কিন্তু চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমণের দুই মাসেরও বেশি পার হলেও এখানকার হাসপাতালগুলোতে হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা রয়েছে হাতেগোনা। যেখানে করোনা আক্রান্ত রোগীর শয্যা অনুযায়ী প্রয়োজন অন্তত ৫০টি হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা, সেখানে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল সবমিলিয়ে রয়েছে সর্বোচ্চ ২০টি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে রয়েছে মাত্র নয়টি। তার মধ্যে আবার সচল রয়েছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ছয়টি। কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ চালু না হওয়ায় জেনারেল হাসপাতালের তিনটি হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা পড়ে রয়েছে অব্যবহৃত। এ তিনটি হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলাই অনুদান হিসেবে পাওয়া। সরকারিভাবে এখনও কোনো হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা জেনারেল হাসপাতালে আসেনি।

অন্যদিকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি হাসপাতাল, রেলওয়ে হাসপাতাল ও হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে একটিও হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা নেই।

বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে রয়েছে চারটি, ম্যাক্স হাসপাতালে দুটি, মেট্রোপলিটন হাসপাতালে একটি, সিএসসিআর হাসপাতালে একটি, ন্যাশনাল হাসপাতালে একটি এবং পার্কভিউ হাসপাতালে দুটি থাকলেও বাকি হাসপাতালগুলোতে একটি বা দুটির বেশি ন্যাসাল ক্যানোলা নেই। তবে হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা থাকলেই হবে না, এটা ব্যবহার করার জন্য হাসপাতালে দরকার সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপোর্ট।

চিকিৎসকরা বলছেন, যখন একজন রোগীর অক্সিজেনের অভাব হয়, তখন ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া হয়। ভেন্টিলেটরের সেই অক্সিজেন প্রবাহ চলে অনেকটা ধীরে ধীরে। কিন্তু রোগীর প্রয়োজন অতি উচ্চমাত্রার অক্সিজেন। যা হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলার মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব। অর্থাৎ এক মিনিটে প্রায় ৯৫ ভাগ অক্সিজেন দ্রুত রোগীর শরীরে সরবরাহ করে থাকে হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা। বলতে গেলে এক মিনিটে কয়েকটা সিলিন্ডারের অক্সিজেন একাই সরবরাহ করে হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা। ওই মুহূর্তে যদি দ্রুত রোগীর শরীরের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন সরবরাহ করা না যায় বা একটু দেরি হলে শরীরের কোনো না কোনো অঙ্গ অচল হয়ে যেতে পারে। আর এতে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি অনেক গুণ বেড়ে যায়।

কোথায় পাওয়া যায়, কতো দাম?
হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। এটা বাইরের দেশ থেকে আনতে হয়। সবচেয়ে ভালো মানের হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা পাওয়া যায় ইউরোপের বাজারে। এর বাইরে কোরিয়া, চীন ও তুরস্কে হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা তৈরি হয়। করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর আগে এই হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলার দাম ছিল আড়াই থেকে তিন লাখ। কিন্তু এখন চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিটি হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলার দাম দাঁড়িয়েছে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা।

এটি আনাতেও এখন নানা ঝামেলা। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আকাশপথে বাংলাদেশের যোগাযোগ বন্ধ থাকায় এখন কোরিয়া থেকে চীন হয়ে তারপর বাংলাদেশে আসছে। তাই খরচ হয়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ। এর বাইরে অসাধু কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে ভালো মানের প্রতিটি হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলার দাম রাখছে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। দেশে আনার জন্য সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হয় আকাশপথের ওপর। আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় সেটা আরও সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা জানান, হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা চালাতে হলে ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। আইসিইউ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছাড়া অন্য ডাক্তাররা সাধারণত এর ব্যবহারবিধি জানবেন না। হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা পরিচালনার জন্য চারজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের প্রয়োজন রয়েছে। সেন্ট্রাল অক্সিজেন ছাড়া হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা অকার্যকর। কোনো রোগীর শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে কিংবা রোগীর অক্সিজেনের স্যাচুরেশন একদম কমে গেলে আরও উচ্চ মাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহের প্রয়োজন পড়ে। আর হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলার মাধ্যমে মিনিটে ৭০-৮০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন সরবরাহ করা যায়। কারণ স্বাভাবিকভাবে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনের মাধ্যমে ১৫ লিটারের বেশি অক্সিজেন রোগীর শরীরে সরবরাহ করা যায় না। যদিও সব রোগীকেই হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা পুরোপুরি সাপোর্ট দিতে পারে না। তখন আইসিইউ এবং ভেন্টিলেটর সাপোর্ট দেওয়ার প্রয়োজন হয়। তবে অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে এ হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলাতেই কাজ হয়ে যায়।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আব্দুর রব চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনা রোগীদের মধ্যে যাদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে, ভেন্টিলেটরের চেয়েও হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা তাদের বেশি প্রয়োজন। যেভাবে আমরা আইসিইউ-আইসিইউ করে হাহাকার করছি আসলে ভেন্টিলেশনে গেলে রোগী খুব একটা ফেরত আসে না। দুই-একজন হয়ত ভাগ্যক্রমে ফেরত আসে। তবে এই মুহূর্তে আমাদের দরকার সেন্ট্রাল অক্সিজেন। অন্তত ২০ থেকে ২৫টি হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা। এটি দিয়েই আমাদের অনেক রোগীকে বাঁচানো সম্ভব। বিশেষ করে যাদের অক্সিজেনের সংকট তাদের জন্য খুব দরকার। এতে আমাদের আইসিইউর ওপরও চাপ কমবে।’

একই প্রসঙ্গে ফৌজদারহাটের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের (বিআইটিআইডি) চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. ইমরুল কায়সার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলার সুবিধা হচ্ছে এটা দিয়ে রোগীকে এক মিনিটে ৬০ থেকে ৭০ লিটার অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব। রোগীর অক্সিজেন স্যাচুরেশন যখন অনেক কমে যায়, তখন অক্সিজেনের সাপ্লাইটা বেশি দিতে হয়— যা এই হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলায় খুব দ্রুত দেওয়া যায়। রোগীর জীবন বাঁচানোর জন্য এটি সবচেয়ে উপকারী এবং এই মুহূর্তে দরকারি। তবে এটার জন্য অবশ্যই হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্রয়োজন। যেসব হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন নেই, সেখানে সাধারণত ব্যবহার করা হয় না।’

চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মোস্তফা খালেদ আহমদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা এখনো সরকারিভাবে আমাদের নেই। আসার প্রক্রিয়া চলছে অধিদপ্তরে। সরকারি সরবরাহেরটা কিছুদিনের মধ্যে পাবো। জেনারেল হাসপাতালের তিনটা ডোনেটেড। যেখানে যেখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম আছে সেখানে এই হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলার প্রয়োজন হয়। তাছাড়া হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা সিলিন্ডারের মাধ্যমে দিলে তেমন লাভ হয় না, সেজন্য সেন্ট্রাল অক্সিজেনের প্রয়োজন। কারণ এটা অনেক দ্রুত রোগী শরীরে প্রবেশ করতে পারে যা ভেন্টিলেশন দিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না।’

তিনি বলেন, ‘ভেন্টিলেটর এবং ন্যাসাল ক্যানোলা ভিন্ন জিনিস। কোভিড আক্রান্ত রোগীদের জন্য মেইন চিকিৎসা অক্সিজেন স্যাচুরেশন ঠিক রাখা। আর এজন্য হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানোলা খুব কার্যকর। সরকারিভাবে যেটা হচ্ছে, সেটা আশা করি চলে আসবে।’

এ প্রসঙ্গে সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটার কনসেপ্টটা নতুন। তাছাড়া সরকারিভাবে এখনও পাইনি। কিছুদিনের মধ্যে আসবে। আর সেন্ট্রাল অক্সিজেন যেখানে নেই, সেখানে এটা চালু করা যায় না। এটা যত বেশি থাকবে, তত বেশি ভালো হয়। কারণ এটা হচ্ছে আইসিইউর পরিপূরক। তার পূর্ব শর্ত হচ্ছে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাগবে। শ্বাসকষ্টের রোগীর জন্য এক ঘণ্টায় ১০ থেকে ১৫ টা সিলিন্ডার লাগবে, যা সেন্ট্রাল অক্সিজেন ছাড়া নরমালি সম্ভব না। আমরা বরাদ্দ চেয়েছি। প্রক্রিয়া চলছে। সরকারি প্রক্রিয়া আসতে অনেক সময় লাগে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!