চট্টগ্রামে করোনা রোগী আইসিইউ পায় না, ১২ হাসপাতালের গল্প পুরোটাই ফাঁকি!

চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানার সরাইপাড়ায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া নারীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ‘আইসিইউ সাপোর্ট দরকার’ বলেই সোমবার (১৩ এপ্রিল) ভোরে ট্রান্সফার করা হয়েছিল চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত ডাক্তাররাও ওই নারীর পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন ‘রোগীর অবস্থা ভাল না, আইসিইউ দরকার।’ তবে আইসিইউর বিষয়ে তাদের (জেনারেল হাসপাতালের) কিছু করার নেই— এটা জানার পর পরিবারের সদস্যরা সকালেই নিজ উদ্যোগে ওই নারীকে নিয়ে যান পাঁচলাইশ কাতালগঞ্জের পার্ক ভিউ হাসপাতালে। সেখানে প্রথমে ভর্তি নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাগজপত্র দেখে ‘সন্দেহ’ হওয়ায় ফিরিয়ে দেয় পার্কভিউ কর্তৃপক্ষ।

তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগা মাকে নিয়ে তিন ঘণ্টা ধরে চমেক-জেনারেল হাসপাতাল-পার্কভিউ হাসপাতাল দৌড়াদৌড়ি করা দুই ছেলে শেষে বাধ্য হয়ে মাকে নিয়ে ফেরেন জেনারেল হাসপাতালে। এরপর আইসোলেশন ওয়ার্ডের বাইরে দাঁড়িয়ে দুই ছেলে ঘন্টাতিনেক ধরে মায়ের নিশ্চিত মৃত্যুর প্রহর গুণেছেন। করোনা আক্রান্ত সেই মা সারা চট্টগ্রাম খুঁজেও শুধুমাত্র একটি আইসিইউর (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) অভাবে সকাল পৌনে ১১টার দিকে অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

চট্টগ্রামে বর্তমানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা হচ্ছে যেখানে, সেই জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে শ্বাসকষ্ট নিয়ে একদিনে দুইজনের মৃত্যুর বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে এসব তথ্য উঠে আসে। এ থেকে প্রশ্ন উঠেছে চট্টগ্রাম কি আদৌ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত? চট্টগ্রামে দিনের পর দিন যেখানে করোনা রোগী বাড়ছে, সেখানে এই এখনও শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের রাখার জন্য একটি আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) কি তৈরি করা গেল না?

মাত্র কিছুদিন আগেই চট্টগ্রামের ১২ বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ বেড ব্যবহারের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ঘটা করে জারি করা হয় প্রজ্ঞাপন। অথচ খোদ জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই বলছে, আইসিইউ সাপোর্ট দরকার হলে কোন প্রক্রিয়ায় কোথায় রোগীকে পাঠাতে হবে সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানা নেই তাদের। চিকিৎসক নেতারা বলছেন, বেসরকারি ১২ হাসপাতালের বেড ব্যবহারের যে কথা বলা হয়েছে সেটা শুধুমাত্র বলার জন্য বলা। আদতে পুরো ব্যাপারটিই একটা মিথ্যাচার ও প্রতারণা। তবে এই বিষয়ে অভিযোগের তীর যাদের দিকে উঠছে, তারা বলছেন কোন রোগীরই আইসিইউ সাপোর্টের দরকার হয়নি এখন পর্যন্ত। প্রয়োজনে ঠিকই আইসিইউ সাপোর্ট পাওয়া যাবে।

করোনায় মারা যাওয়া সরাইপাড়ার সেই রোগীর চিকিৎসার ঘটনাক্রম খুঁজতে গিয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, রোববার (১২ এপ্রিল) রাত ১০টায় ওই নারীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। প্রথমে তাকে হৃদরোগের রোগী ভেবে ১২ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। পরে সেখান থেকে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে প্রাথমিক পর্যায়ে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া হয় তাকে, ইনজেকশনও দেওয়া হয়। এরপর ওই নারী খানিকটা সুস্থবোধ করলেও রাত ৩টার দিকে তার শ্বাসকষ্ট প্রকট হয়ে দেখা দেয়। তখন দায়িত্বরত চিকিৎসক তার পরিবারের সদস্যদের জানান রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট দরকার। তারা ধারণা করছেন এটি করোনার কেইস। এজন্য তারা রোগীকে জেনারেল হাসপাতালে রেফার করেন।

রোববার (১৩ এপ্রিল) ভোর ৪টার দিকে তাকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানকার জরুরি বিভাগের ডাক্তার কাগজপত্র দেখে বলেন রোগীর অবস্থা ভাল না। তাকে প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে আইসিইউ সাপোর্ট দেওয়া গেলে ভাল হবে। সেখানে প্রায় ১ ঘন্টা অবস্থান করলেও রোগীকে গাড়ি থেকে নামানো কিংবা আইসিইউতে এডমিট করানোর বিষয়ে কোন উদ্যোগ না দেখে বাধ্য হয়ে পরিবারের সদস্যরা চলে যান পাঁচলাইশ কাতালগঞ্জের পার্কভিউ হসপিটালে। সেখানে আইসিইউ সিটের কথা বলার পর তারা চমেকের কাগজপত্র দেখে জানায় তাদের আইসিইউ সিট খালি নেই। কাতর অনুরোধ করেও কোন সমাধান না পেয়ে মাকে নিয়ে আবার জেনারেল হাসপাতালে ফিরেন তার ছেলেরা। সকাল ৭টার দিকে জেনারেল হাসপাতালে করোনার আইসোলেশন ওয়ার্ডে তাকে ভর্তি করান তারা।

আইসোলেশন ওয়ার্ডের ডাক্তারদের চেষ্টার ঘাটতি ছিল না জানিয়ে রোগীর ছেলে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আইসোলেশন ওয়ার্ডে নেওয়ার পর ডাক্তাররা উনাকে অক্সিজেন দিয়েছিলেন। তার কিছু টেস্টও করিয়েছেন। কিন্তু তারা আমাকে বলে দিয়েছিলেন কোন আশা নেই। ৯৯.৯৯ শতাংশ সম্ভাবনা শেষ।’ সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে তিনি মারা যান।’

তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়েও আইসিইউ সাপোর্ট না পেয়ে মারা যাওয়া ওই নারীর ছেলে বলেন, ‘শুনেছি ১২টা হাসপাতাল সরকারকে কথা দিয়েছে তাদের আইসিইউ বেড দেবে। দুই জায়গা থেকে আইসিইউ দরকার বলার পরও তারা নিজেরা কোন ব্যবস্থা করলো না। আমরা নিজেরা পার্কভিউতে গিয়েও সাড়া পেলাম না। তিনি ছয়টি ঘন্টা আমাদের সামনে ছটফট করে মারা গেলেন আমাদের মা। আমরা কিছুই করতে পারলাম না। যদি আইসিইউ সিট নাই দেবে— তাহলে এমন ঘোষণা তারা কেন দিল?’

রোগীকে পার্ক ভিউ হাসপাতালে নেওয়া এবং সেখান থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করে নিয়েছে পার্ক ভিউ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সিভিল সার্জনও। পার্কভিউ হাসপাতালের এডমিন অফিসের কর্মকর্তা মো. আরাফাত চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এক নারী এসেছিল। তার করোনা সংক্রমণের সিনড্রোম থাকায় আমরা জেনারেল হাসপাতালে যেতে বলেছি। তাকে রেফারও করা হয়েছিল সেখানে।’

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘তারা জেনারেল হাসপাতাল থেকে পার্কভিউতে গিয়েছিল। তবে সেটা জেনারেল হাসপাতাল পাঠায়নি। তারা (রোগীর আত্মীয়) নিজ উদ্যোগে নিয়ে গেছে।’

আইসিইউ সাপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে রোগীকে কী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে— এই প্রশ্নের জবাবে সিভিল সার্জন বলেন, ‘জেনারেল হাসপাতাল যদি মনে করে তাহলে তারাই রোগীকে পাঠাবে। আর তখন রোগীকে আইসিইউ সাপোর্ট দেওয়া হবে।’

এই বিষয়ে জানতে গিয়ে উঠে এল আরও ভয়ংকর তথ্য। জানা গেল, করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ১২ হাসপাতালের আইসিইউ বেড দেয়ার ঘোষণা পুরোটাই একটা শুভঙ্করের ফাঁকি। জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে দায়িত্বরত একজন ডাক্তার নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আপনার যে প্রশ্ন একই প্রশ্ন আমাদেরও। আমরা প্রশাসনকে বারবার বলেছি আমাদের এনসিউর (নিশ্চিত) করা হোক। পার্ক ভিউ দেবে নাকি ম্যাক্স দেবে— তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। আমরা শুধু সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাই যে কোথায় গেলে রোগী ভর্তি হতে পারবে। কিন্তু এখানে আমাদের ১২ হাসপাতালের একটা লিস্ট ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যারা আলটিমেটলি কেউ প্রস্তুত না এবং কেউ রাজিও না।’

এমনকি একজন রোগীর আইসিইউ সেবা দরকার হলে তাকে কী প্রসেসে কোথায় পাঠাতে হবে— এই বিষয়ে কিছুই জানেন না খোদ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কও। এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা আমি বলতে পারবো না। আমার কাছে ইনফরমেশন নাই। এটার উত্তর দিতে পারবে আমাদের পরিচালক (বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক) ও সিভিল সার্জন।’

চমেক সূত্র, রোগীর ছেলে ও আইসোলেশন ওয়ার্ডের ডাক্তারের বক্তব্য একই দিকে ইঙ্গিত করলেও এক্ষেত্রে সিভিল সার্জন ও জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের বক্তব্য পুরোপুরি ভিন্ন। সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাকে আরও একজন প্রশ্ন করেছেন রোগীকে আইসিইউতে পাঠানোর জটিলতা নিয়ে। আমি কাগজপত্র সব দেখেছি। তারা তো রোগীকে পার্কভিউতে পাঠায়নি। পাঠিয়েছে জেনারেল হাসপাতাল। যদি পার্কভিউতে বলা হতো আমরা ব্যবস্থা নিতাম।’

অন্যদিকে জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ বলেন, ‘রোগীর পার্সিয়েল প্রেসার অক্সিজেন তো খারাপ ছিল না। আইসিইউ লাগার কথা না।’

তবে এই পুরো প্রক্রিয়াতে যে বড় রকমের একটা সমন্বয়হীনতা আছে তা অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমানের কথায়। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় এই সাংগঠনিক সম্পাদক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘১২টা হাসপাতাল রেডি কাগজে কলমে। আইসিইউ সাপোর্ট নিয়ে যা হচ্ছে— এগুলো সব প্রতারণা আর মিথ্যাচার। জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ বেডগুলো চালু হওয়ার আগে আইসিইউ সাপোর্টের দরকার হওয়া রোগীগুলোর মৃত্যুর খবরই পাওয়া যাবে শুধু এভাবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!