চট্টগ্রামে করোনার ৭০০ টিকা সরিয়ে ‘পুশ’ হল টাকার বিনিময়ে, নিবন্ধন ছিল না কারোরই

অনুমতি নেই, তবু দেওয়া হল ইউনিয়ন পর্যায়ে

চট্টগ্রামে সিনোফার্মের তৈরি করোনার অন্তত ৭০০ টিকা অনুমতি ছাড়াই সরিয়ে রেখে সেসব দেওয়া হয়েছে নিবন্ধনহীন বিশেষ বিশেষ লোককে। ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাপ্রতি ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে দেওয়া এসব টিকা দেওয়ার ব্যাপারে কোথাও থেকে অনুমতিও নেওয়া হয়নি। শুক্রবার (৩০ জুলাই) ও শনিবার (৩১ জুলাই) টানা দুদিন ধরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে কৌশলে টিকাগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

এমন নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায়। যার বিরুদ্ধে সরাসরি টিকা সরানোর অভিযোগ উঠেছে, তিনি পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট রবিউল হোসেন। এদিকে টিকা নিয়ে এমন জালিয়াতির কারণে শনিবার (৩১ জুলাই) পটিয়ায় সংকটে পড়ে টিকাদান কার্যক্রম। টিকা না পেয়ে ফিরে গেছেন অনেকেই।

জানা গেছে, পটিয়া উপজেলার শোভনদণ্ডী ইউনিয়নে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করোনার টিকা দেওয়ার অবৈধ এই আয়োজন করা হয় রীতিমতো ব্যানার টাঙ্গিয়ে। সবশেষ শনিবার (৩১ জুলাই) টিকা দেওয়ার আসর বসে শোভনদণ্ডী ডিগ্রি কলেজে।

একটি সূত্র জানিয়েছে, গত দুই দিনে শোভনদণ্ডী ইউনিয়নে এভাবে টিকা দেওয়া হয়েছে অন্তত দেড় থেকে দুই হাজার লোককে। সিনোফার্মের তৈরি একেকটি টিকা দুজনকে দেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে ধারণা করা হচ্ছে সেখানে ৭০০ থেকে ৭৫০টি টিকা দেওয়া হয়েছে দুই দিনে। পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সব্যসাচী নাথ অবশ্য চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বললেন, ‘কতোগুলো টিকা সরানো হয়েছে, সেটা এখনও আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি।’

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার শোভনদণ্ডী ইউনিয়নে বসেছিল অর্থের বিনিময়ে টিকা দেওয়ার আসর। নিবন্ধন ছিল না কারোরই।
চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার শোভনদণ্ডী ইউনিয়নে বসেছিল অর্থের বিনিময়ে টিকা দেওয়ার আসর। নিবন্ধন ছিল না কারোরই।

এদিকে এই ঘটনায় শনিবার (৩১ জুলাই) তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট (অর্থোপেডিক সার্জারি) ডা. অজয় দাশের নেতৃত্বাধীন ওই তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. নুরুল হায়দার এবং চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. আসিফ খান। কমিটিকে বিষয়টি তদন্ত করে দুই কর্মদিবসের মধ্যে বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীরের এ সংক্রান্ত এক চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘সরকারিভাবে ইউনিয়ন পর্যায়ে কোভিড-১৯ (সিনোফার্ম) টিকা প্রদান করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। নিম্নস্বাক্ষরকারী বিশ্বস্ত সূত্রে অবগত হন যে, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে উপজেলা, জেলা কিংবা বিভাগীয় পর্যায় থেকে কোন প্রকার অনুমতি না নিয়ে চট্টগ্রাম জেলাধীন পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে উক্ত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ইপিআই) মো. রবিউল হোসেন কর্তৃক ৩০/৭/২০২১ এবং ৩০/৭/২০২১ কোভিড-১৯ (সিনোফার্ম) ভ্যাকসিন অন্যত্র নিয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে রেজিস্ট্রেশনবিহীন লোকদের প্রদান করা হয়েছে।’

জানা গেছে, পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট রবিউল হোসেনের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নতুন কিছু নয়। ঢাকার একটি সরকারি হাসপাতাল থেকে অবৈধভাবে করোনাভাইরাসের টিকা সংগ্রহ করে মানুষের কাছে উচ্চমূল্যে সেসব বিক্রির গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহল থেকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কাছে পাঠানো একটি অভিযোগ চট্টগ্রাম প্রতিদিনের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার শোভনদণ্ডী ইউনিয়নে বসেছিল অর্থের বিনিময়ে টিকা দেওয়ার আসর। নিবন্ধন ছিল না কারোরই।
চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার শোভনদণ্ডী ইউনিয়নে বসেছিল অর্থের বিনিময়ে টিকা দেওয়ার আসর। নিবন্ধন ছিল না কারোরই।

টেকনোলজিস্ট রবিউল হোসেনের বিরুদ্ধে এছাড়া স্বাস্থ্য সহকারীদের টিকা সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র (ইনজেকশন, সিরিঞ্জ ইত্যাদি) দেওয়াতে হয়রানি করা, বিভিন্ন প্রোগ্রামে স্বাস্থ্য সহকারীদের ভাতা পাওনায় ইচ্ছাকৃত ভোগান্তি তৈরি করা, করোনাভাইরাসের রেজিস্ট্রেশনে অবৈধভাবে টাকা আদায় করা, ভ্যাকসিন দেওয়ার সময় মানুষকে অহেতুক হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে সেই শুরু থেকে। এমনকি তার স্ত্রী স্বাস্থ্য সহকারী কুলসুমা আকতারকে মাঠ পর্যায় থেকে এনে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ করানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জানা গেছে, কর্মস্থলে বেশিরভাগ সময় তার স্ত্রী অনুপস্থিত থাকলেও হাজিরা খাতায় রবিউল নিজেই স্বাক্ষর দিয়ে দেন উপস্থিতির।

এ বিষয়ে জানতে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট রবিউল হোসেনের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। পরে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

রাতে পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সব্যসাচী নাথ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এভাবে অবৈধভাবে টিকা সরানো এবং পরবর্তীতে সেগুলো নিবন্ধনহীন ব্যক্তিদের দেওয়ার বিষয়টি আমরা শনাক্ত করি শুক্রবার রাতে। এরপর শনিবার (৩১ জুলাই) আমি নিজেই সরেজমিনে গিয়ে শোভনদণ্ডী ডিগ্রি কলেজে এভাবে টিকা মারার বিষয়টি দেখতে পাই। সঙ্গে সঙ্গেই আমি বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!