চট্টগ্রামে করোনার ফাঁকে থাবা বসানোর অপেক্ষায় ডেঙ্গু

করোনায় ‘ব্যস্ত’ সিটি কর্পোরেশন

বৈশাখের মেঘলা দিনে দিনভর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর নগরজুড়ে জায়গায় জায়গায় জমে থাকা পানি জানান দিচ্ছে মশা বেশ জমিয়েই করতে যাচ্ছে বংশবিস্তার। এর মধ্যেই কালবৈশাখীর দাপট দেখতে শুরু করেছে নগরবাসী। দুই দফা বৃষ্টিতে মশার উৎপাতও বেড়েছে দ্বিগুণ। তবে মুজিববর্ষকে সামনে রেখে গেল নভেম্বর থেকে ঢাকঢোল পিটিয়ে ওষুধ ছিটিয়ে মশা তাড়ানোর মহাপরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। কিন্তু অচিরেই তাতে ছেদ পড়ে সিটি নির্বাচনের অজুহাতে। থমকে যায় চসিকের মশা মারা কার্যক্রম। এরপর খোদ প্রধানমন্ত্রীর কড়া বার্তায় আবার একটু নড়েচড়ে বসেন চসিক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১০ দিনের সময়ও চেয়ে নেন তিনি। কিন্তু তোড়জোড় থেমে যেতেও সময় লাগেনি। নির্বাচন স্থগিত হল, দোকানপাট বন্ধ হল, গণপরিবহনের চাকা থামলো— কিন্তু থেমে নেই চট্টগ্রাম নগরজুড়ে মশার অসহনীয় বংশবিস্তার।

করোনার সম্ভাব্য খারাপ পরিস্থিতির আশঙ্কায় নেওয়া হচ্ছে নানা প্রতিরোধী পদক্ষেপ। অথচ গত বছরের ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, গেল তিন বছরের চাইতে কয়েকগুণ বেশি ছিল। তাতেও যেন নজর নেই কর্তৃপক্ষের। তার ওপর চট্টগ্রামে গেল তিন বছর টানা মশক জরিপ না হওয়ায় কোন্ ধরনের মশার ঘনত্ব বেশি তাও সঠিক জানা নেই কর্তৃপক্ষের। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) এখন করোনাভাইরাস নিয়ে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু তাদের মাথাব্যথা নেই, এই ফাঁকেই আড়ালে উঁকি দিচ্ছে আরেক প্রাণঘাতী রোগ ডেঙ্গু— সুযোগ বুঝে যা ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতি বছরই।

চট্টগ্রামে করোনার ফাঁকে থাবা বসানোর অপেক্ষায় ডেঙ্গু 1

চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন নালা-নর্দমার বদ্ধ পানিতে প্রচুর মশা দেখা যাচ্ছে এই সময়ে। সেখানে নির্বিচারে ডিম পাড়ছে মশা। ওষুধ ছিটিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তা নগরবাসীর জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তখন করোনা আর ডেঙ্গুর প্রকোপে নাজেহাল হবে নগরবাসী। তাতে করোনা আর ডেঙ্গু যোগ হয়ে নগরবাসীর জন্য হয়ে দাঁড়াবে মরার ওপর খাড়ার ঘা।

ঢাকায় নিয়মিত মশক জরিপ কার্যক্রম চালু রয়েছে। চলতি বছরেই ঢাকায় শ দুয়েক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে করোনা নিয়ে ব্যস্ততার অজুহাতে ডেঙ্গুর সম্ভাব্য বিস্তার নিয়ে মাথাব্যথা নেই চট্টগ্রামে। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, করোনার ভেতরেও মশা মারার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। কিন্তু তাতে যেন নগরবাসীর দুর্ভোগ আরও বাড়ছেই। দিনের পর দিন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে মশার সংখ্যা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্ষার মৌসুমে কার্যকর আগাম পদক্ষেপ না নেওয়া হলে এবারও ডেঙ্গু পরিস্থিতি হাতের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। কিন্তু করোনার কারণে সব ‘ফোকাস’ অন্যদিকে চলে গেছে। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের দিকটা অনেকটাই আড়ালে থেকে গেছে। যদিও প্রতিরোধের কথা যখনই ওঠে, গতানুগতিক ধারার মন্তব্য দিয়ে দায়সারা কাজকর্ম সারেন চসিকের কর্তারা।

চসিকের মহাপরিকল্পনায় বলা হয়েছিল প্রতিটি ওয়ার্ডকে চার ভাগে ভাগ করে প্রতিটি ভাগের রাস্তা, ফুটপাত, গলি, উপ-গলি, নালা-নর্দমা ‘যথাযথভাবে’ পরিষ্কার এবং মশক নিধনে স্প্রে করা হবে। প্রতি মাসে ৪ বার এ কার্যক্রম পরিচালিত হবে। কিন্তু বর্তমান দৃশ্যপটে কথায় কাজে মিল নেই কোথাও। এমন কার্যক্রম কোন্ এলাকাবাসী কবে দেখেছে— এটা কের করাও রীতিমতো গবেষণার বিষয়।

নগরীর ডবলমুরিং থানার চারিয়া পাড়া এলাকার বাসিন্দা জহির আহমেদ বলেন, ‘কী যে বলেন না! কিসের মাসে চার বার? গত চার মাসে একবারও স্প্রে ম্যানদের দেখেছি কিনা সন্দেহ আছে। দেখেন গা, এখন করোনা আসায় তারা উছিলা দেখাচ্ছে কাজ না করার। এরাই নাকি আমাদের নগরসেবক।’

জানা যায়, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বেশিরভাগ ওয়ার্ডে দেওয়া হয়েছে একটি করে ফগার মেশিন (মশার ওষুধ ছিটানোর যন্ত্র)। কিন্তু বেশিদিন ব্যবহারের ফলে এসব মেশিন এখন অকেজো প্রায়। এক ঘণ্টা ব্যবহারের পরই গরম হয়ে আগুন ধরে যাচ্ছে এসব মেশিনে। তার সাথে স্প্রেম্যানের সংকট তো আছেই।

কিন্তু এমন অভিযোগ অস্বীকার করে চসিকের প্রধান পরিছন্ন কর্মকর্তা শেখ শফিকুল মান্নান সিদ্দিকী বললেন, ‘প্রতিটি ওয়ার্ডে ২-৪টি ফগার মেশিন দেওয়া হয়। আর স্প্রেম্যান দেওয়া হয় তিন থেকে চারজন। সবাই ওষুধ ছিটাচ্ছে নিয়মিত। তাছাড়া সব জায়গায় প্রচার করছি। বিজ্ঞাপন আকারে দিচ্ছি।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রায় চার হাজার লিটার লার্ভিসাইড (লার্ভা ধ্বংসকারী) ওষুধের মজুত আছে। প্রতিনিয়ত আমাদের কর্মীরা ওষুধ দিচ্ছে।’

একই প্রসঙ্গে চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা এখন করোনা নিয়ে ব্যস্ত আছি। আপনার অবস্থান থেকে আপনিও করোনা নিয়ে কাজ করেন। জনগণকে সচেতন করেন।’

ডেঙ্গু প্রতিরোধের চেষ্টা কি তাহলে বাদ— এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনার প্রায়োরিটিটা চিন্তা করতে হবে আগে। এখন করোনা নিয়েই ব্যস্ত আমরা।’

এদিকে করোনা ভাইরাস এবং ডেঙ্গু সংক্রমণের বিস্তার ভিন্ন হওয়ায় চিকিৎসা ব্যবস্থাও পুরো আলাদা। তবে দুই ক্ষেত্রেই সচেতন হতে হবে সকলকে। তাই আগাম পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে বলেও মন্তব্য করেছেন সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দুইটা ট্রিটমেন্ট দুই ধরনের। তবে দুই ক্ষেত্রেই সচেতন থাকতে হবে সকলকে। একসঙ্গে দুইটা দেখা দিলে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে আমাদের।’

সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘এখনও চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগীর কোনো তথ্য পাইনি। সামনে বৃষ্টি হতে পারে। তখন এর প্রকোপ বাড়বে। আমরা সিটি করপোরেশনকে চিঠিও দিয়েছি যে মশার দিকে খবর নেন এবং ওষুধ ছিটান। নাহলে একসঙ্গে দুটি মহামারি দেখা দিলে আমাদের জন্য বিপদ হবে। ডেঙ্গু কিন্তু এখন সারা বছরের রোগ। ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য কাজ করতে হবে। আর যদি ডেঙ্গুর রি-ইনফেকশন হয়, তাহলে তো আরও বিপদ।’

প্রসঙ্গত, গত ৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের জেলা প্রশাসকদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আরেকটা পয়েন্ট আছে, এরপরে আসবে মশার প্রাদুর্ভাব ডেঙ্গু, কাজেই মশা মারার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।’
এর জবাবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে আশ্বস্ত করছি গত বছরও ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। আল্লাহর রহমতে চট্টগ্রামে হয়নি আমরা যথাযথ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার কারণেই। এ বছরও আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি, অলরেডি আমি মিটিং করেছি, সংশ্লিষ্টদের সাথে সরাসরি কথা বলেছি। গত তিনদিন ধরে আমরা ব্যাপকভাবে মশার ওষুধ ছিটাচ্ছি। আগামী ১০ দিনের মধ্যে এটা একেবারে সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!