চট্টগ্রামে করোনার প্রধান ল্যাবে দুটি মেশিন নিয়ে ১২ জনের দিনরাতের যুদ্ধ

চট্টগ্রামে করোনাভাইরাস পরীক্ষার প্রধান ল্যাবটিই চলছে ১২ জন লোকবল ও দুটি পিসিআর মেশিন দিয়ে। স্বাভাবিকভাবে এই ল্যাবের সক্ষমতা রয়েছে ৪০টি নমুনা পরীক্ষার। অথচ সেখানেই এখন এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি পরীক্ষা হচ্ছে করোনাভাইরাসের নমুনার। এমন হিমশিম অবস্থা নিয়েই চলছে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটস্থ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের (বিআইটিআইডি) ল্যাব।

২৬ মার্চ থেকে চলে আসা করোনাভাইরাস পরীক্ষার ২৯তম দিনে বৃহস্পতিবার (২৩ এপ্রিল) রেকর্ড পরিমাণ ১৮৪টি নমুনা পরীক্ষা করেছে বিআইটিআইডি। এর আগের দিন ১৬৫টি নমুনা পরীক্ষা হয় বিআইটিআইডির ল্যাবে। তবে সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হলো এই ১৮৪টি নমুনাই গত ১৮ এপ্রিল সংগ্রহ করা। নমুনা সংগ্রহের ৪ দিন পর সেগুলো পরীক্ষা করা সম্ভব হয়েছে ল্যাবে। এর মধ্যেই তাদের হাতে জমে গেল গত ৫ দিনের সংগ্রহ করা নমুনা। ঠিক কতগুলো নমুনা এই মুহূর্তে বিআইটিআইডিতে জমে আছে— এই বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা না গেলেও ল্যাব প্রধান ডা. শাকিল আহমেদ জানিয়েছে এটি কোনভাবেই ৮০০ এর কম হবে না।

স্বল্প জনবল ও দুটিমাত্র মেশিন নিয়ে পুরো চট্টগ্রামের চাপ সামাল দেওয়া বিআইটিআইডিতে নমুনার চাপে বেহাল দশার একটা চিত্র এটি। তবে এজন্য অবশ্য ল্যাব সংশ্লিষ্টদের কোন দায় দেওয়ার সুযোগও নেই। ১২ জন টেকনোলজিস্টের এই দলটি প্রতিদিন তিন শিফটে ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা টানা কাজ করেও এই নমুনার স্তুপকে টলাতে পারছেন সামান্যই।

তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর এবং চট্টগ্রামের ১৪টি উপজেলা ও মহানগরী থেকে গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ৩০০টি করোনাভাইরাস পরীক্ষার স্যাম্পল আসছে বিআইটিআইডিতে। কিন্তু কয়েকদিন আগেও প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১২০টি নমুনা পরীক্ষা করা যাচ্ছিল বিআইটিআইডির ল্যাবে। ফলে স্যাম্পলের ফলাফল পেতে রোগীদের ৩-৪ দিন অপেক্ষা করতে হয়।

এতে বেশ কিছু সমস্যাও দেখা দিয়েছে। যেমন ৩-৪ দিন পর নমুনা পরীক্ষায় আসলে সঠিক ফলাফল মেলে কিনা— ক্ষীণভাবে সেই প্রশ্নটাও উঠেছে কোথাও কোথাও। সংকট তৈরি হচ্ছে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও। যেমন ৬ দিন আইসোলেশনে থাকার পর রোগীর রি-টেস্ট করানোর কথা রয়েছে। সেই নমুনার ফল পেতে লাগছে ৪ দিন। এর পর দ্বিতীয় দফা টেস্ট দিতে এবং সেটার ফলাফল পেতেও হচ্ছে দেরি। ফলে আইসোলেশন ওয়ার্ডের চিকিৎসা সেবায় এর একটা প্রভাব পড়ছে বলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন।

পাশাপাশি করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া রোগীদের ফলাফল আসতে দেরি হওয়ায় এর মধ্যে তাদের দাফন-কাফন থেকেও সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। যেমনটা ঘটেছে সাতকানিয়ার আলীনগর ইছামতির সিরাজুল ইসলামের ক্ষেত্রে। গত ৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেডিকেলে মারা যান তিনি। এরপর ১১ এপ্রিল তার নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে জানা যায়, তিনি করোনা পজিটিভ ছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে তার দাফন-কাফনে অংশ নিয়ে ঝুঁকিতে পড়েন অন্তত ৪০০ পরিবার। এখন পর্যন্ত ওই দাফন কাফনে অংশ নেওয়া ৬ জন করোনা পজেটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন।

অন্যদিকে বিআইটিআইডি ল্যাবের ইনচার্জ ডা. শাকিল আহমেদ বলেন, ‘দেরিতে পরীক্ষা করায় আমাদের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে আমরা প্রতিদিন কতজন আক্রান্ত হচ্ছে এর সঠিক তথ্যটা পাচ্ছি না। তবে ৩-৪ দিন পর টেস্ট হলে ফলাফলে কোন প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নাই। এক সপ্তাহ পর্যন্ত ঠিক থাকবে এটা। এখন যেভাবে জট বাধছে, এটা সামাল দেওয়া না গেলে অসুবিধা হবে। আজকে আমরা ১৮ তারিখের নমুনা পরীক্ষা করলাম। গত ৫ দিনের নমুনা জমে গেল।’

তবে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিভাসু) ল্যাব চালু হওয়াকে আশার ব্যাপার হিসেবে দেখছেন ডা. শাকিল আহমেদ। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘শনিবার থেকে নতুন করে কাজ শুরু হচ্ছে সিভাসুর ল্যাবে। আমাদের এখান থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করবেন তারা। কাজেই এখান থেকে প্রেসার কিছুটা কমবে। আমরা অনেকদিন ধরেই বলছি ল্যাব বাড়ানোর কথা। চমেকের বিষয়টাও আলাপ হচ্ছে।‘

তবে ল্যাব ছাড়াও অন্য কিছু সমস্যাও আছে বিআইটিআইডিতে। এখন যে ১২ জনের টিম, তাদের দিয়েই নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে পরীক্ষা সবই করাতে হচ্ছে। সারাদিন শহর ঘুরে নমুনা সংগ্রহ তাদের জন্য বেশ দুঃসাধ্য ব্যাপার। নমুনা সংগ্রহে জেনারেল হাসপাতাল আলাদা করে কাজ করলেও সেখানেও আছে লোকবলের সমস্যা। মাত্র দুজন টেকনোলজিস্ট নিয়ে কাজ চালাচ্ছে তারা। বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের পক্ষ থেকে জেনারেল হাসপাতালের অনুকূলে ৬ জন টেকনোলজিস্টকে সাময়িক সংযুক্ত করার কথা বলা হলেও এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এই বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু না জানার কথা বলেছেন জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক অসীম কুমার নাথ।

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!