চট্টগ্রামে করোনাকালেই জমজমাট ঘরোয়া খাবারের অনলাইন ব্যবসা

নগরেই শুধু নয়, ছড়িয়ে পড়েছে উপজেলাগুলোতেও

করোনাভাইরাসে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলো যখন বন্ধ, তখন হঠাৎ করেই জমজমাট হয়ে ওঠে ঘরে তৈরি খাবারের বিকিকিনি। চট্টগ্রাম মহানগরেই নয় কেবল, এমনকি আশেপাশের উপজেলাগুলোতেও এমন দৃশ্য দেখা গেছে করোনাকালে। এই দুর্যোগের সময়েই মোবাইল ফোন ও ফেসবুক ব্যবহার করে ঘরে তৈরি করা খাবারের ব্যবসা অনেকটা চোখের পলকে পেয়েছে অবিশ্বাস্য গতি।

করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত সব শ্রেণীর মানুষই অনলাইনে অর্ডার দিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত তাজা খাবার কেনার দিকে ঝুঁকেছে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায়। এ ধরনের ব্যবসা টাকা কামানোর এক নতুন সুযোগ তৈরি করেছে হঠাৎ করেই। এমন অবস্থায় বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তারা বাড়িতে গড়ে তোলা তাদের ছোট ছোট ব্যবসাগুলো অনলাইনে সরিয়ে নিতে সময় নেননি।

চিটাগাং উইম্যান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট মনোয়ারা হাকিম আলী বললেন, ‘করোনার সময়ে যখন সব ব্যবসাই বিপুল লোকসান গুণেছে, তখন আমাদের মেয়েরা প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে ঘরে তৈরি খাবারের ব্যবসা বাড়িয়েছে। রীতিমতো একটি দুর্যোগের মধ্যেই অভাবনীয় উত্থান হয়েছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের, যা আমাদের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।’

এমন উত্থানে আশাবাদী মনোয়ারা হাকিম আলী জানালেন সামনের করণীয়ও— ‘উইম্যান চেম্বার এখন এই উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেবে। তারা যেন ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ পায় এবং তাদের পণ্যের ওপর ভিত্তি করে একটি বাজার গড়ে তুলতে পারে— সে ব্যাপারে আমরা সাহায্য করবো।’

চট্টগ্রাম শহরের কাজির দেউড়ি এলাকার বাসিন্দা সেলিনা আক্তার ১০ বছর ধরে বাসায় তৈরি খাবারের ব্যবসা করে আসছেন। তার প্রতিষ্ঠান ‘সাইদ কিচেন’ স্বাভাবিক সময়ে প্রতি সপ্তাহে ১০ হাজার টাকা মূল্যের খাবার বিক্রি করতো। কিন্তু করোনা মহামারী আঘাত হানার পর প্রতি সপ্তাহে তার বিক্রি গিয়ে দাঁড়ায় গড়ে ৩০ হাজার টাকায়।

সেলিনা বললেন, ‘করোনাভাইরাস যখন আঘাত হানলো, এর প্রভাবে যখন হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ হয়ে গেল— সেই তখন থেকে মানুষ বাড়িতে তৈরি খাবারের দিকে ঝুঁকতে থাকে। ওই সময় থেকে আমাদের গ্রাহক ক্রমেই বাড়ছিল। আমাদের কাছ থেকে স্বাস্থ্যকর ও তাজা খাবারের নিশ্চয়তা পেয়ে দিন দিন গ্রাহকের সংখ্যা বাড়তেই থাকে।’

‘সাইদ কিচেনের’ এই কর্ণধার বলেন, ‘নিজস্ব লোক ছাড়াও খাবার সরবরাহের বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমেও আমরা খাবার পাঠাই গ্রাহকের বাসায়।’

কাজির দেউড়ি এলাকারই আরেক গৃহিণী লিলিও ফেসবুকে তার ‘লিলি হোমমেইড ফুড’ নিয়ে বেশ পসার জমিয়ে বসেছেন।

কাজির দেউড়ি থেকে হালিশহর দূরত্ব অনেক। কিন্তু কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক ইশরাত জাহানের গল্পও একইরকম। চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর এলাকার এই বাসিন্দা জানালেন, স্কুল চলাকালে হালকা খাবারের প্রয়োজন হয়— এমন কিছু স্কুলে তিনি ঘরে তৈরি খাবার সরবরাহের ব্যবসা শুরু করেন সেই ২০১৯ সালের মার্চ মাসে।

করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলে ইশরাত জাহান ফেসবুকের আশ্রয় নেন। সামাজিক যোগাযোগের ওই মাধ্যমে তিনি ‘টিফিন টিফিন’ ব্রান্ড নাম দিয়ে একটি প্রচারণা শুরু করেন। অল্প সময়েই এই প্রচারণা বেশ সাড়া ফেলে দিল। ঘরে তৈরি খাবারের জন্য প্রচুর অর্ডার পেতে থাকলেন তিনি। সেই ধারাবাহিকতা চলছে এখনও।

ক্রেতারা কেন অনলাইনের খাবারের দিকে ঝুঁকছে, চট্টগ্রামের শুলকবহরের বাসিন্দা মাইনুল হক এই প্রশ্নই খোলাসা করে বললেন, ‘পরিবার নিয়ে রেস্তোরাঁয় যাওয়া এখনও অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। তাই আমরা বাড়িতে তৈরি খাবার অর্ডার করি অনলাইনেই। বিক্রেতারাও এগুলো আমাদের বাড়িতে এসে দিয়ে যায়।’

চট্টগ্রামে ঘরোয়া খাবার সরবরাহ করে ‘টুকি-টাকি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এর কর্ণধার সাইরিন সাকী জানালেন, বাসায় তৈরি খাবারের প্রতি গ্রাহকদের ঝুঁকছে মূলত সুস্বাদু স্বাস্থ্যকর খাবার সরবরাহের নিশ্চয়তা থেকেই।

তিনি বললেন, ‘আমি ব্যবসাটি শুরু করেছি মাত্র দু মাস আগে। পরিবার থেকে যেমন এ নিয়ে উৎসাহ পাচ্ছি, তারাও আবার নানাভাবে বেশ সহায়তা দিচ্ছেন আমাকে।’

প্রকৃতপক্ষে চট্টগ্রাম নগরই নয় শুধু, চট্টগ্রামের উপজেলাগুলোতেও ঘরে তৈরি খাবারের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে। এ ধরনের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদেরও মূল ভরসা ওই একটিই— অনলাইন। এদের প্রায় সকলেই ফেসবুকে পেইজ বা গ্রুপ খুলে সেখানে লোভনীয় বিভিন্ন খাবারের ছবি পোস্ট করছেন। গ্রাহকরা তাদের পছন্দসই খাবারসামগ্রী বেছে নিয়ে অর্ডার দিচ্ছেন, কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সেই খাবার গ্রাহকের দরজায় পৌঁছে যাচ্ছে।

ফটিকছড়িতে নীপা নামের এক নারী উদ্যোক্তা খুলেছেন ‘অনলাইন রেস্টুরেন্ট’। পুরো ফটিকছড়িতেই তিনি খাবার সরবরাহ করেন। চট্টগ্রামে ঝর্না নামে এক গৃহিণী ফেসবুকেই খুলেছেন ‘ঝর্না’স ফুড ম্যাজিক’। ঘরে তৈরি খাবার ছাড়াও পিঠা-পুলির অর্ডারও পাচ্ছেন বেশ। এমন উদ্যোক্তার সংখ্যা এখন অনেক— আনাচেকানাচে।

নতুন উদ্যোক্তাদের নিয়ে তৈরি ফেসবুক গ্রুপ ‘মিরসরাই ই-কমার্স ফোরামের’ অ্যাডমিন শরীফ মাহমুদ বলেন, ‘করোনা মহামারী অনলাইন ব্যবসার বিস্তার ঘটিয়েছে বলতে গেলে চোখের পলকে।’

তিনি বলেন, ‘নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির ফেসবুক গ্রুপটিতে বাড়িতে তৈরি খাবারের বিক্রেতাদের প্রমোট করার কাজে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে বেশি। বিক্রেতারাই কেবল তাদের সামগ্রীর ছবি ও তথ্য ফেসবুকে পোস্ট করে না, ক্রেতারাও তাদের পছন্দের খাবার নিয়ে পোস্ট করে। আমরা এই ক্রেতাদের সঙ্গে উদ্যোক্তাদের সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’

তানজু অনলাইন শপিং-এর কর্ণধার তানজিনা আক্তার তানজু জানালেন, অনলাইনে তিনি অনেকদিন ধরেই পোশাক বিক্রি করছেন। কিন্তু মাত্র দুই মাস আগে তার অনলাইন দোকানে বাড়িতে তৈরি খাবার যোগ করার পর দেখেন, এই ধরনের খাবার সরবরাহের বেশ চাহিদা রয়েছে গ্রাহকদের মধ্যে।

তানজিনা বলেন, ‘আমি আমাদের ডেলিভারি সার্ভিসের মাধ্যমে গ্রাহকদের প্রায় ২০ ধরনের আইটেম সরবরাহ করি। এর মধ্যে রয়েছে মসলাদার স্ন্যাকস, বিরিয়ানি, পিৎজা এবং চিকেন ফ্রাইসহ আরও নানা আইটেম।’

অন্য অনেকের মতো তানজিনারও বিশ্বাস, বাসায় তৈরি খাবারের চাহিদা দিন দিন আরও বাড়তে থাকবে— যদি উদ্যোক্তারা তাদের সেবার মান ধরে রাখতে পারেন।

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড অবলম্বনে

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!