চট্টগ্রামে এসে ১০ হাজার টাকায় যেভাবে ভোটার হলেন এক রোহিঙ্গা

কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামে এসে মাত্র ১০ হাজার টাকায় ভোটার হয়ে গেছেন এক রোহিঙ্গা। বাংলাদেশী জাতীয়তা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তার সংগ্রহে ছিল আগেই। কক্সবাজার পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ পাহাড়তলীর ইসলামপুরে দীর্ঘদিন ধরে সপরিবারে বসবাস করে আসা রোহিঙ্গা ফয়াজ উল্লাহ (৩৯) রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) বিকেলে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর নেপথ্যের পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন।

কক্সবাজার পৌরসভার ইসলামপুরে তিনি ফয়াজ উল্লাহর একটি চায়ের দোকান আছে। ভোটার আইডি কার্ড অনুযায়ী তার পিতার নাম মৃত লাল মিয়া, মায়ের নাম চেমন বাহার। তার স্ত্রী মাহমুদা খাতুনও (৩৭) রোহিঙ্গা। প্রায় ২৫ বছর ধরে তারা সপরিবারে কক্সবাজার পৌর এলাকায় বসবাস করে আসছেন। অনেকেই জানতো না তারা রোহিঙ্গা। আর যারা জানতো, তারাও অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রকাশ করেনি। অবশেষে নির্বাচন কমিশনের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে রোহিঙ্গা ফয়াজ উল্লাহ বাংলাদেশী আইডি কার্ড পাওয়ার পেছনে পিলে চমকানো তথ্য।

রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) বিকেলে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর ফয়াজ উল্লাহ জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য দিয়েছেন। ফয়াজ উল্লাহ জানিয়েছেন, ভোটার হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টগুলো তিনি বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে সংগ্রহ করেন। ভোটার হওয়ার নির্ধারিত আবেদন ফরম পূরণ করে অনেকবার কক্সবাজার নির্বাচন অফিসে যান। কিন্তু অপর্যাপ্ত ডকুমেন্ট ও সন্দেহযুক্ত আবেদন হওয়ায় তাকে বারবার ফেরত দেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।

এরপর ফন্দি আঁটেন, কোন পন্থায় ভোটার হওয়া যায়? বের করলেন একটি উপায়।

খোকন (ফয়াজ উল্লাহর ভাষ্যমতে) নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রামে গিয়ে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ভোটার হওয়ার জন্য ছবি তোলেন। ফয়াজ উল্লাহর মিশন সাকসেস! যথারীতি নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

সম্প্রতি চট্টগ্রামে লাকি আক্তার নামের এক রোহিঙ্গা নারী শনাক্ত হয়। যার হাতে স্মার্টকার্ড পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। ওই লাকি আক্তারের বিস্তারিত তথ্য অনুসন্ধান করতে বেরিয়ে আসে ফয়াজ উল্লাহসহ আরো বেশ কয়েকজনের নাম— রোহিঙ্গা হওয়ার পরও যাদের নাম নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে চূড়ান্ত হয়ে ঢুকে যায়।

টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত রোহিঙ্গা ডাকাত নূর মোহাম্মদের স্মার্টকার্ড পাওয়ার পেছনের তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে ফয়াজ উল্লাহসহ আরো বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার তথ্য পাওয়া যায়। এরপর থেকে নড়েচড়ে বসে নির্বাচন কমিশন।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আশরাফুল হুদা ছিদ্দিকী জামশেদ জানান, ফয়াজ উল্লাহ অনেক বছর ধরে সত্তারঘোনা এলাকায় বসবাস করে আসছেন। চট্টগ্রামের ঠিকানা দিয়ে তিনি ভোটার হয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে কোন্ পন্থায় ভোটার হয়েছেন তা অবগত নন বলে জানান কাউন্সিলর জামশেদ।

তিনি জানান, তথ্য সংগ্রহ, যাচাই-বাছাই ও চূড়ান্ত অনুমোদন সবকিছু নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত।

কক্সবাজার জেলা নির্বাচন অফিসার শাহাদাত হোসাইন জানান, তথ্য জালিয়াতি করে বাংলাদেশের ভোটার হয়েছে এমন পাঁচ রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করে তাদের বিস্তারিত তথ্য নিতে কক্সবাজার নির্বাচন অফিসে পাঠায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। তারা হলেন পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ পাহাড়তলীর ইসলামপুরের বাসিন্দা ফয়াজ উল্লাহ (৩৯), ১ নম্বর ওয়ার্ডের কুতুবদিয়াপাড়ার (নাজিরারটেক) বাসিন্দা মো. আইয়ুবের স্ত্রী নুরতাজ (৪১), সদরের পিএমখালী ৪ নং ওয়ার্ডের জুমছড়ির বাসিন্দা মৃত আব্দুল হাকিমের ছেলে মোহাম্মদ নোমান (৪১), সদরের ঝিলংজা ৪ নং ওয়ার্ডের পশ্চিম কোনারপাড়ার বাসিন্দা নুরুল ইসলামের ছেলে এহসান উল্লাহ (১৯)।

রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) বিকেলে তাদের মধ্য থেকে ফয়েজ উল্লাহকে আটক করে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়। তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা বিস্তারিত অনুসন্ধান করছেন।

কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাচন অফিসার শিমুল শর্মা জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের নির্দেশনার আলোকে রোহিঙ্গা নাগরিক ভোটার হওয়ার বিষয়ে সরেজমিন তদন্তকালে ৫ জন রোহিঙ্গার বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া যায়। যার নম্বর যথাক্রমে ১৯৮০২২২২৪০৭০০০০২২, ১৯৯৮২২২২৪০৭০০০০২৩, ২০০১২২১২৪৪৭০০০০০১, ১৯৭৮২২২২৪০১০০০০১০, ১৯৭৮২২১২৪৭১০০০০২৩। অনলাইনে যাচাই করে দেখা যায় তারা ২০১৯ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় তালিকাভুক্ত হন।

শিমুল শর্মা জানান, রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন ল্যাপটপ আইডি নং যথাক্রমে ০৩৫১-০০০০ এবং ৯৩১৮-০০০০—সদর উপজেলার ল্যাপটপ আইডির সাথে যার মিল নেই। তাছাড়া তাদের ভোটার আবেদন ফরমের সাথে উপজেলা থেকে সরবরাহকৃত ফরমেরও অমিল রয়েছে।

এসব বিষয় যাচাই-বাছাই করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সদর থানা পুলিশের সহযোগিতায় ৫ জন রোহিঙ্গার মধ্য থেকে ফয়াজ উল্লাহ নামের একজনকে আটক করা হয়।

সদর উপজেলা নির্বাচন অফিসার জানান, রোহিঙ্গা ফয়াজ উল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি স্বীকার করেছেন ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি চট্টগ্রামে গিয়ে ভোটার হওয়ার জন্য ছবি তোলেন।

এদিকে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় কিছু অসাধু জনপ্রতিনিধির সহায়তায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জাতীয়তা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে।

তাছাড়া ভোটার হালনাগাদে তথ্য সংগ্রহে নিয়োজিত কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও এসব জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। অসাধু কিছু লোকের কারণে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র পৌঁছে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের হাতে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!