চট্টগ্রামে এসে প্রতারিত তরুণকে তিন বছর পর পরিবার খুঁজে পেল শ্রীমঙ্গলের জঙ্গলে

পুরো বছর কাজ করিয়ে টাকাই দেয়নি চট্টগ্রামের ঠিকাদার

আজ থেকে তিন বছর আগে ময়মনসিংহের ছেলে শরীফ আলী কাউকে কিছু না বলে চলে এসেছিলেন চট্টগ্রামে। কোনো একভাবে চট্টগ্রামের এক ঠিকাদার তাকে কাজ দেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। সেই আশ্বাসে ময়মনসিংহ থেকে চট্টগ্রাম চলে আসেন ২২ বছরের শরীফ। অচেনা চট্টগ্রামে ছেলেটাকে আসতে দিতে পরিবারের কারোরই মত ছিল না। কিন্তু শরীফ তার বাবা খোরশেদ আলীকে বুঝিয়েছিলেন, চট্টগ্রামে গিয়ে ভালো কাজ পাবেন তিনি। টাকা রোজগার করে বাড়িতেও পাঠাতে পারবেন। তবু বাবা ছাড়তে চাননি তাকে। শেষে পরিবারকে না জানিয়েই চট্টগ্রাম চলে আসেন শরীফ। সেটা ২০১৭ সাল।

কিন্তু চট্টগ্রামে তার জন্য অপেক্ষা করছিল শুধুই প্রতারণা। চট্টগ্রামের ঠিকাদার তাকে দালান নির্মাণের পাইলিং কাজে লাগান ঠিকই, কিন্তু মজুরি আর দেন না। আজ দিচ্ছে-কাল দিচ্ছে বলে বলে মাসের পর মাস যেতে থাকে। এমনকি বছরও ফুরোয়। কিন্তু টাকা পায় না শরীফ আলী। এমন অবস্থায় ময়মনসিংহের বাড়িতেও ফিরে যেতে পারেন না— বাবার কাছে মুখ দেখাবেন কী করে সেই ভয়ে।

পুরো এক বছর কাজ করিয়ে চট্টগ্রামের সেই ঠিকাদার শরীফকে একটি টাকাও দেয়নি। ইটভাটার শ্রমিক থেকে চট্টগ্রামে এসে নির্মাণ শ্রমিক বনে যাওয়া শরীফ এভাবে প্রতারণার শিকার হয়ে চট্টগ্রামে থাকতেই একপর্যায়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। কৈশোর পেরুনো শরীফ আলী উন্মাদের বেশে ঘুরতে থাকেন বিভিন্ন জায়গায়। কখনও তাকে রাস্তার পাশে শুয়ে থাকতে দেখা যেতো। কখনও আবার রাত কাটাতেন বনজঙ্গলের ভেতরেও। একসময় তিনি চলে যান সিলেটের মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে।

রীতিমতো আয়োজন করে শ্রীমঙ্গলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা শরীফকে তুলে দিলেন বাবার হাতে।
রীতিমতো আয়োজন করে শ্রীমঙ্গলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা শরীফকে তুলে দিলেন বাবার হাতে।

লাউয়াছড়ার বনে উদভ্রান্ত এই তরুণকে হঠাৎ চোখে পড়ে শ্রীমঙ্গল কেব্‌ল সিস্টেমের ভাইস চেয়ারম্যান পার্থ সারথি দাশের। কিন্তু বাড়ি ময়মনসিংহ— এইটুকু তথ্য ছাড়া শরীফের কাছ থেকে আর কিছুই জানা গেল না। শেষে তিনি ফেসবুকে তুলে ধরেন শরীফের কথা। ফেসবুকের সেই পোস্ট শ্রীমঙ্গলের তরুণ সমাজকর্মীদের নজরে আসে। তারা কয়েকজন মিলে গত ২৪ সেপ্টেম্বর শরীফকে উদ্ধার করেন। তার আলুথালু চুল-দাড়ি কেটে দিয়ে গোসল করান। নতুন পোশাকও পরানো হয় তাকে।

পরে শরীফকে শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মের এক জায়গায় থাকতে দেওয়া হয়। এরপর ফেসবুকে শরীফের পরিবারের খোঁজে চলতে থাকে প্রচারণা। হঠাৎ সেই পোস্ট চোখে পড়ে শরীফের চাচাতো ভাই আসিফ উর রহমানের। অগোছালো চুল-দাড়িতে শরীফকে চেনা কষ্টকর হলেও আসিফ একনজর দেখেই ভাইকে চিনে ফেলেন। তখনই তিনি বিষয়টি শরীফের বাবাকে জানান। পরে ফেসবুকের মাধ্যমে তার পরিবারের লোকজন যোগাযোগ করেন শ্রীমঙ্গলে।

শরীফের বাড়ি ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার পংদারীকেল গ্রামে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর শ্রীমঙ্গলে পৌঁছান শরীফের বাবা খোরশেদ আলম। স্থানীয় একটি স্কুলের নৈশপ্রহরী তিনি। তার এক ছেলে আর এক মেয়ের মধ্যে শরীফ ছোট।

দীর্ঘদিন পর ছেলেকে দেখে আবেগে ভেসে যান বাবা খোরশেদ। ছেলেকে ফিরে পাবেন, সেই বিশ্বাসও হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ ছেলেটাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে বাবার চোখে জমে ওঠে অশ্রু। রীতিমতো ছোটখাট আয়োজন করে শ্রীমঙ্গলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা শরীফকে তুলে দিলেন বাবার হাতে।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর সকালে শ্রীমঙ্গল উপজেলা পরিষদের প্রাঙ্গণে শরীফকে তার বাবা খোরশেদ আলীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নজরুল ইসলাম, অঙ্গীকার সামাজিক ও সাহিত্য পরিষদের সভাপতি শেখ সরোয়ার জাহান, আমরা স্বেচ্ছায় রক্ত দিই নামের সামাজিক সংগঠনের সভাপতি মো. ইমু, সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!