চট্টগ্রামে এবার চালের দাম হঠাৎ বাঁধনহারা

হু হু করে বাড়ছে চালের দাম। পেঁয়াজের দাম বাড়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটি সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে হঠাৎ বাড়িয়ে দিয়েছে চালের দামও। একসপ্তাহের ব্যবধানে চট্টগ্রাম নগরীর বাজারগুলোতে প্রকারভেদে চালের দাম বেড়েছে প্রতি কেজিতে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ টাকা। এজন্য প্রশাসনের দুর্বল বাজার মনিটরিং ব্যবস্থাকেই দুষছেন ক্রেতারা।

হঠাৎ চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিশেষ করে চরম হতাশায় ভুগছেন নিম্নমধ্যবিত্ত ক্রেতারা। তারা বলছেন, বর্তমান বাজারে যেন কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। কারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে তা খতিয়ে দেখে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বড় বিপর্যয় ঘটে যাবে।

ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়ার কোন সুনির্দিষ্ট কারণ দেখাতে পারেনি। তারা ‘সংকট’ বলে দায় এড়াতে চাইলেও মূলত চালের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বাড়ানোর বিষয়টি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে।

সরেজমিনে দেখা যায়, সাতদিনের ব্যবধানে চট্টগ্রামের বাজারে চালের দাম বেড়েছে প্রতিকেজিতে কমপক্ষে ৫ টাকা থেকে ৭ টাকা। এক্ষেত্রে নিম্নমধ্যবিত্ত ক্রেতাদের ভোগ্য চালের দামের পার্থক্য কিছুটা কম। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের ভোগ্য চালের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। তবে পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারে এ পার্থক্য আরো বেশি। পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা বাজারের চালের দামে প্রতিকেজিতে ৩-৪ টাকা পার্থক্য রয়েছে।

চকবাজার
চকবাজার ঘুরে দেখা যায়, চালের খুচরা বাজারে চিনিগুড়া চালের দাম প্রতি কেজিতে ৯০ টাকা থেকে বেড়ে ৯৫ টাকা, ১ নম্বর কাটারি ৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৬৫ টাকা, গোবিন্দভোগ ৭০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ টাকা, সঙ্গ মিনিকেট ৪৩ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকা, দেশি নাজিরশাইল ৫৬ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকা, ইন্ডিয়ান নাজিরশাইল ৬০ থেকে ৬৩ টাকা, ২৮ বেতী ৩৩ টাকা থেকে ৩৫ টাকা, ফাইজার ৪৩ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকা, জিরাশাইল ৪৫ টাকা ৪৮ টাকা, বালাম সিদ্ধ ২৫ টাকা, দেশি মিনিকেট ৩৫ টাকা থেকে ৩৮ টাকা, থাইল্যান্ড বেতী ৩৮ টাকা থেকে ৪০ টাকা, নুরজাহান সিদ্ধ ৩৫ থেকে বেড়ে ৩৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কাজীর দেউড়ি বাজার
নগরীর স্টেডিয়াম পাড়ার এই বাজারে চিনিগুড়া চাল প্রতি কেজিতে ৯৫ টাকা থেকে বেড়ে ১০০ টাকা, ১ নম্বর কাটারি ৬৫ টাকা থেকে বেড়ে ৭০ টাকা, গোবিন্দভোগ ৭৫ টাকা থেকে বেড়ে ৮৩ টাকা, সঙ্গ মিনিকেট ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকা, দেশি নাজিরশাইল ৫৬ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকা, ইন্ডিয়ান নাজিরশাইল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, ২৮ বেতী ৩৩ টাকা থেকে ৩৫ টাকা, ফাইজার ৪৩ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকা, জিরাশাইল ৪৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা, কাটারি আতব ৬০ টাকা, কাটারি সিদ্ধ ৮৫ টাকা থেকে ৯০ টাকা, দেশি মিনিকেট ৪০ টাকা থেকে ৪৫ টাকা, মোটা সিদ্ধ ৩২ টাকা থেকে ৩৮ টাকা, নুরজাহান সিদ্ধ ৩৭ থেকে বেড়ে ৩৮ টাকা হয়েছে।

চাক্তাই পাইকারি বাজার
চাক্তাই পাইকারি বাজারে প্রতি ৫০ কেজি চালের বস্তা বেতী ১৬৫০ থেকে বেড়ে ১৭৫০ টাকা, যার প্রতি কেজিতে বেড়েছে ২ টাকা। সিদ্ধ জিরাশাইল ২০০০ থেকে ২৩০০ টাকা, যা প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৬ টাকা। ফাইজার ১৪৫০ থেকে বেড়ে ১৬০০ টাকা, যা প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৩ টাকা। দেশি কাটারী ২৪০০ থেকে ২৪৫০ টাকা, যা প্রতি কেজিতে বেড়েছে ১ টাকা। নুরজাহান ১৪৫০ থেকে ১৫৫০ টাকা, যা প্রতি কেজিতে বেড়েছে ২ টাকা। মিনিকেট আতপ ২৫ কেজি বস্তা ৮৮০ থেকে ৯২০ টাকা, যা প্রতি কেজিতে বেড়েছে ১.৬ টাকা। নাজিরশাইল ২৫ কেজি বস্তা ১১৫০ থেকে ১২৫০, যা প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৪ টাকা, নতুন চাল ২৫ বস্তা ৯৭০ থেকে ১০২০ টাকা, যা প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৩ টাকা। কাটারি সিদ্ধ ২৫ কেজি বস্তা ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা, যা প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৪ টাকা। নতুন কাটারী ৯৭০ টাকা থেকে ১০২০ টাকা, নুরজাহান সিদ্ধ ১৪৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

পাইকারি বাজারে চালের দাম প্রতি কেজিতে ২ থেকে ৬ টাকা হারে বাড়লেও খুচরা ব্যবসায়ীরা তুলনামূলকভাবে দাম আরও বেশি নিচ্ছে। পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার সাথে সাথে আবার হঠাৎ করেই নিত্যপ্রয়োজনীয় চালের দাম বাড়ার কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সাধারণ ক্রেতারা।

রিক্সাচালক মো. জয়নাল বললেন, ‘মুরগির দাম ১৩০ টাকা হওয়ায় আমাদের ভাগ্যে ১৫ দিনে একবার জোটে। ভালো ফলমূলও খেতে পারে না আমাদের মতো গরিব মানুষ। দামের কারণে রান্নাতে পেঁয়াজ বন্ধ। এবার যে ডাল ভাত খেয়ে বাঁচবো সে উপায়ও রাখছে না চাল ব্যবসায়ীরা। কাল (রোববার) চাল কিনতে গিয়ে দেখি প্রতি কেজি ৫ থেকে ৬ টাকা চালের দাম বাড়িয়ে দিল। আমরা কী খেয়ে বাঁচবো তাহলে? আমাদের কথা কি সরকার ভাবে না?’

গার্মেন্টসকর্মী খাদিজা খাতুন বলেন, ‘বাসায় ৫ ছেলেমেয়ে নিয়ে বসবাস আমার, স্বামীও কিছু করে না। মাস শেষে ৭ হাজার টাকা বেতন পাই। বাসা ভাড়া, বাচ্চাদের খাওয়া দাওয়া মাসের অর্ধেকই টাকা শেষ হয়ে। সে জায়গায় দিনের পর দিন জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে আমরা কী করে চলবো? আজ মোটা সিদ্ধ চাল কিনতে এলাম যার দাম বলছে ৩৮ টাকা। অথচ গত সপ্তাহে কিনলাম ৩২ টাকা দিয়ে। সপ্তাহের মধ্যে যদি এক কেজি চালে ৬ টাকা বেড়ে যায় তাহলে কী করে ভাত খাবো?’

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মো. আনোয়ার চৌধুরী বলেন, ‘৫০ কেজি ফাইজার চাল গত মাসে কিনলাম ১৪৫০ টাকা দিয়ে। আর আজকে বলছে ১৬০০ টাকা। এক বস্তার ওপর ১৫০ টাকা বাড়িয়ে ফেললো। আমরা চাকরিজীবি মানুষ। মাস শেষে তো আর বেতনটা হঠাৎ করে বেড়ে যায় না। কিন্তু এভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে গেলে আমাদের জন্যই মুশকিল হয়ে যায়।’

চকবাজারের চালবিক্রেতা এনামুল বাবলু জানান, ‘পাইকারি বাজারে চালের দাম বাড়লে তার প্রভাব তো খুচরা বাজারে অবশ্যই পড়বে। পাহাড়তলী, চাক্তাই চালের পাইকারি বাজারে দাম বেড়ে গেছে হঠাৎ করে। যার কারণে আমাদেরও সেই দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। পাইকারি বাজারের বিভিন্ন সিন্ডিকেট নিজেদের লাভের জন্য হঠাৎ করেই চালের দাম বাড়িয়ে ফেলেছে যেটা সাধারণ মানুষের ওপরই বেশি প্রভাব ফেলছে।’

হঠাৎ চালের দাম বাড়ার প্রসঙ্গে কাজীর দেউড়ি এলাকার চাল বিক্রেতা আজিম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা পাহাড়তলী থেকেই পাইকারিভাবে চাল আনি। কিন্তু পাহাড়তলীতে মিল মালিকরা চালের দাম বাড়িয়ে ফেলার কারণে আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। চালের আড়তদারা চালের দাম বাড়িয়ে ফেললে আমাদেরও করার কিছুই থাকে না।’

বিষয়টি স্বীকার করে চাক্তাই চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আসলে মজুতকৃত চাল এখন শেষ পর্যায়ে। কয়েকদিন পর নতুন চাল আসবে। ঠিক এই মুহূর্তে সাধারণত চালের দাম বাড়ে। অন্য আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে অন্যান্য সময় ধান বের হলেই সরকার ধান কেনার কথা ঘোষণা করে। কিন্তু সরকার এবার ধান বের হওয়ার আগেই ধান কেনার ঘোষণা করেছে। তাই হঠাৎ করেই ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।’

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. হাসানুজ্জামান দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বর্তমানে সরকার ধান কিনছে। সাধারণত সরকার যখন ধান কিনে তখন ধানের দাম একটু বাড়ে। ধানের দাম যেহেতু বেশি, মিলাররা বেশি দামেই কিনছে। এজন্য চালের দামটা একটু বেড়ে গিয়েছে। তাছাড়া আমাদের যে তদারকি সেক্ষেত্রে আমরা দেখি ব্যবসায়ীরা চাল কী পরিমাণ এনেছে, মূল্যতালিকা দিচ্ছে কিনা এসব। এতে কোনো কারসাজি হয়ে থাকলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলতে পারবে। কারণ কৃষিপণ্যের দামটা তারাই তদারকি করে। তাদের কাজ থেকে তথ্য নিয়েই আমরা অভিযান চালাই।’

চট্টগ্রামের জেলা বাজার কর্মকর্তা সেলিম মিয়া বলেন, ‘প্রতি বছর চট্টগ্রামে চালের ঘাটতি থাকে। চট্টগ্রামে যা ধান হয় তাতে এখানকার মানুষ তিন মাসের চাহিদাই পূরণ করতে পারে না। ভৈরব, আশুগঞ্জ, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, উত্তরবঙ্গ এসব এলাকা থেকেই চাল আসে। তাছাড়া সিদ্ধ চালের ৭৫ ভাগই আসে এসব এলাকা থেকে। এসব এলাকায় চালের দাম বাড়ার কারণে এখানেও বেড়ে গেছে।’

তিনি আরও জানান, ‘খুচরাতে বেড়েছে ৩-৪ টাকা। আর পাইকারিতে বস্তাপ্রতি ২০০-৩০০-৪০০ এভাবে বেড়েছে। তাছাড়া চালের দামটা যদি এরকমই থাকে এবং কৃষক যদি নায্যমূল্য পায় আমার মতে এতোটা খারাপ হবে না। তাছাড়া কৃষকদের সাথে ষড়যন্ত্র করে কয়েকটা সিণ্ডিকেট দাম বাড়িয়ে ফেলে। তবে এখন ধান কাটা শুরু হচ্ছে সামনে নতুন ধান আসবে। তখন চালের দাম কমে যাবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!