চট্টগ্রামে এবার আবর্জনা থেকে ডিজেল-সার তৈরির চিন্তা, বিদ্যুতেই দশক পার

২০২২ সালে চট্টগ্রাম নগরীর বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে বলে জানিয়েছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। কিন্তু ২০২৩ সাল চলে আসলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোনো অস্তিত্ব নেই নগরীতে।

এরমধ্যে মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) বর্জ্য নিয়ে আবারও নতুন করে আশার বাণী শোনালেন মেয়র রেজাউল। এবার তিনি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে উন্নত করে বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তর করবেন বলে জানিয়েছেন।

স্থানীয় সরকার বিভাগের কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলাপকালে মেয়র এই মন্তব্য করেন। প্রশ্ন উঠেছে, তিনি (মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী) কি কথা রাখতে পারবেন?

জানা গেছে, বর্জ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে জৈব সার, ডিজেল উৎপাদন করতে চট্টগ্রামে দুটি প্লান্ট স্থাপন করতে চায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এজন্য সিটি কর্পোরেশনে কাছে ১০ একর জায়গা বরাদ্দের প্রস্তাব করে মন্ত্রণালয়। মেয়র এই ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেন।

মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট বিষয়ক প্রকল্প পরিচালক আব্দুল হামিদ, কনসালটেন্ট ইফতেখার এনায়েতল্লাহ হালিশহর টিজি ও এক নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের নতুন প্লান্ট স্থাপনের নির্ধারিত জায়গা পরিদর্শন করেন।

এক দশকের বেশি সময় ধরে সিটি কর্পোরেশন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়নে নানা প্রকল্প হাতে নেয়। কিন্তু সেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি। সংগ্রহ করা বর্জ্য নির্দিষ্ট জায়গায় স্তূপ করে রাখা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্যের স্তূপের আকার বড় হলে বিশাল পরিমাণ জায়গার প্রয়োজন পড়ে। উন্মুক্ত জায়গা বর্জ্য রাখায় পরিবেশও দূষণ হয়। তাই বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করে জৈব সার, ডিজেল ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে একদিকে জায়গার সাশ্রয় এবং অপরদিকে সিটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি স্থায়ী সমাধান হবে। পরিবেশ দূষণের মাত্রা হ্রাস ও নাগরিক সেবার মান বৃদ্ধি পাবে।

সেবার মান বৃদ্ধি হবে, নাকি আগের প্রকল্পের মতো এটিও মুখ তুবড়ে পড়বে—সেই প্রশ্ন নগরবাসীর।

মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২১ সালের ৩ মে চাইনিজ ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা মেয়রের সঙ্গে দেখা করে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তারা দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার প্রস্তাব দেন। প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য দৈনিক ১২০০-১৩০০ টন বর্জ্য এবং প্রতি কেন্দ্রের জন্য ১২-১৩ একর করে জমি প্রয়োজন বলে সিটি কর্পোরেশনকে জানানো হয়।

একই সময়ে সৌদি-জার্মান টেকনোলজি লিমিটেড নামে বিদেশি প্রতিষ্ঠান আরেকটি প্রস্তাব দেয়। তারা প্রকল্প বাস্তবায়নে ৪০ একর ভূমির কথা জানায়। প্রতিষ্ঠানটি বর্জ্য সংগ্রহ, সংগ্রহের জন্য যাবতীয় যানবাহন ও লোকবল, ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে নিয়ে যাওয়াসহ সব ব্যবস্থাপনা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে আগ্রহী। কিন্তু এসব উদ্যোগেরও কোনো অগ্রগতি নেই।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে নগরীর ষোলশহরের নবীনগর এলাকার ৮০টি বাড়ির ৩০০ পরিবারকে নিয়ে একটি পাইলট প্রকল্প পরিচালিত হয়। তখন সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, চিহ্নিত প্রতিটি বাড়ির সামনে একটি করে ঢাকনাযুক্ত বিন দেওয়া হবে। কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নির্দিষ্ট সময়ে ওই বিন থেকে বাড়ির মালিকদের ফেলা গৃহস্থালি বর্জ্য সংগ্রহ করে নিয়ে যাবেন। তবে ডাস্টবিনে থাকবে পলিথিন। অর্থাৎ পলিথিনে মুড়িয়ে বর্জ্যগুলো নিয়ে যাওয়া হবে। এতে ডাস্টবিনটিও অপরিচ্ছন্ন হবে না। এছাড়া প্রতি দুই বাড়ি পরপর একটি করে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র স্থাপন করা হবে। কিন্তু তার বিন্দুমাত্র এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।

এর আগে ২০১৫ সালে দেশের পাঁচটি সিটি করপোরেশনে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এমন উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর ও ২৯ ডিসেম্বর এবং ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল একটি সমঝোতা স্মারকের খসড়া পাঠিয়েছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। সেখানে ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কথা বলা হয়। কিন্তু তাতে সাড়া দেয়নি সিটি কর্পোরেশন। এরপর ২০১৮ সালের ২০ আগস্ট ও ১৫ অক্টোবরও পিডিবি খসড়া পাঠায় সিটি কর্পোরেশনকে, যেখানে ২৫ মেগাওয়াটের বিষয়টি উল্লেখ ছিল।

সর্বশেষ ২০১৮ সালের অক্টোবরে সমাঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। তবে সেইবারও ভূমি জটিলতায় প্রকল্পটির আলোর মুখ দেখেনি।

বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২০১৩ সালে ইতালিয়ান কোম্পানি ‘ম্যানেজমেন্ট এনভায়রনমেন্ট ফিন্যান্স এসআরএল’র সঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি চুক্তি হয়েছিল। কথা ছিল, কোম্পানিটি রাজধানীর বর্জ্য দিয়ে দৈনিক ৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে এবং পর্যায়ক্রমে তা বৃদ্ধি করে ১০০ মেগাওয়াট করবে। কিন্তু সেই প্রকল্পও বাস্তবায়ন হয়নি।

পরে ‘রিনিউয়েবল এনার্জি কোম্পানি’র একটি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আগ্রহ দেখায়। তবে সেই উদ্যোগও বেশি দূর এগোতে পারেনি। এসব ছাড়াও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি উদ্যোগ নিলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুমোদন জটিলতার কারণে সফল হয়নি।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!