চট্টগ্রামে এনআইডি সংশোধনের হিড়িক, প্রতারণায় জড়াচ্ছে ৮০ শতাংশ লোক

চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) নাম সংশোধনের জন্য আবেদন করেছেন ভদন্ত সচিতাংকর। কিন্তু এখন তিনি নাম সংশোধন করে রাখতে চাইছেন ‘বিপ্লব বড়ুয়া’। আরেকটি আবেদনে একজনের বাবার বর্তমান নাম রয়েছে ‘জহিরুল আলম’। সংশোধন করে তিনি চাইছেন ‘নজরুল ইসলাম’ করতে।

এই আবেদন দুটি দেখা যায় চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামানের টেবিলে।

এই দু’জনের মতো জটিল আবেদন ছাড়াও প্রতিদিন চট্টগ্রাম নগরীর জুবিলী রোডের আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ে ভিড় বাড়ছে মানুষের।

রোববার (১৯ জুন) সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কার্যালয়ের নিচতলা থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত ভীড়। এদের প্রায় অনেকে এসেছেন এনআইডি সংশোধন করতে। একইসঙ্গে সবার মুখে ছিল হয়রানির অভিযোগ।

তবে সেবাপ্রার্থীদের এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, ৮০ শতাংশ লোক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব এনআইডি সংশোধন করতে আবেদন করেন। সংশোধনের পর তারা কোনো অনৈতিক কাজে জড়ালে প্রশ্নবিদ্ধ হবে নির্বাচন কমিশন। এজন্য সংশোধন করার আগে যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করা হয়। আর এতে সময়ও বেশি লাগে। আবার অনেকে ঠিকভাবে কাগজপত্রও দেখাতে পারেন না।

এদিকে যাদের নাম আমাদের ক্লারিক্যাল ভুলে হয়েছে সেটি অনলাইনে আবেদন করলে দ্রুত ঠিক করে দেওয়া হয় বলে জানান চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান।

চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বাসিন্দা কামাল হোসেন। জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ ও ফি দিয়ে আবেদন করেন অনলাইনে। এরপর অনেক দিন অতিবাহিত হলেও পাননি এনআইডির সংশোধিত কপি। এ নিয়ে স্থানীয় উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে কয়েকবার গিয়েছেন। কিন্তু কোনো ফল পাননি। পরে তাদের পরামর্শে যান জেলা নির্বাচন অফিসে। সেখানে আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার রুমে যেতেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সিকিউরিটি গার্ড তাকে তাড়িয়ে দেন।

এভাবে কামাল হোসেনের মতো অনেকে প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছেন জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে। কিন্তু সংশোধনতো দূরের কথা তাদের কথা শোনার লোকও নেই বলে অভিযোগ অনেকে। সেইসঙ্গে দালালদের টাকা না দিলে কাজ হয় না বলেও অভিযোগ শোনা গেছে।

কার্যালয়ের নিচতলায় কথা হয় আব্দুল ওয়াদুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এনআইডিতে আমার মায়ের নামে ছালমা খাতুনের জায়গায় ছালাম খাতুন এসেছে। এ ভুল সংশোধনে আবেদন ফরম পূরণ করে অনলাইনে জমা দিয়েছি। কিন্তু কোনো সমাধান পাইনি। এ নিয়ে দু’বার এসেছি এখানে।’

জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করতে আসা ইয়াকুব বলেন, ‘ভুল সংশোধন করতে এসে এখানে চরম হয়রানি হতে হচ্ছে। একাধিকবার এ কার্যালয়ে আসতে হচ্ছে। এ জটিলতার সুযোগ নিয়ে এখানে সৃষ্টি হয়েছে দালালচক্র। যারা টাকা দিচ্ছে, তাদের সমস্যার সমাধান হচ্ছে। যারা দালাল ধরছে না, তাদের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।’

জটিল আবেদনগুলো নিয়ে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘এসব ক্ষেত্রে আমাদের নানা কৌশল ও সতর্কতা অবলম্বন করে তদন্ত করতে হয়। আবেদনকারীর সংশ্লিষ্ট এলাকায় তদন্তে যায় স্থানীয় নির্বাচন কর্মকর্তা। এসব আবেদন চাইলেইতো সংশোধন করে দেওয়া যায় না। কারণ, এসব সংশোধিত আবেদনকারীরা নাম সংশোধন করে বড় কোনো অপরাধে জড়িয়ে নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। তাই আমরা সময় নিই, যাচাই করি।’

মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘২০১৭ সালের শেষে আমরা নাম সংশোধনের অথরিটি পাই। এরমধ্যে চলে গেছে প্রায় চার বছরের বেশি সময়। কিন্তু বর্তমানে নাম সংশোধনে যারা আসছে, তাদের বিষয়ে তদন্ত করে দেখি প্রায় ৮০ শতাংশই প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছেন।’

কোন ধরনের প্রতারণা করছে−জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে অনেকে ডাবল রেশন নিতে বিয়ে না করেই ভুয়া স্ত্রী দেখিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রে যোগ করেন। পরে বিয়ে করলে সেই ভুয়া স্ত্রীর নাম বদলাতে সংশোধনের আবেদন করেন। আবার বাবার সম্পত্তি ভোগ-দখল করতে বিদেশে অবস্থান করার সময় বাবার নাম বদলে পাসপোর্ট বানায়। তারাও পরে সেটি সংশোধনের জন্য আবেদন করে।’

হাসানুজ্জামান আরও বলেন, ‘প্রতিদিন আমাকে ৫০টির বেশি আবেদনের শুনানি করতে হয়। যেটি আমার কাছে ভুয়া মনে হয় সেটির তদন্ত করেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। প্রতিমাসে আমাকে হাজারেরও বেশি শুনানি করতে হয়। এ শুনানিতে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। কারণ একজন মানুষের নাম, পিতা-মাতার নাম চেঞ্জ করে অনেক বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। অনেক সময় আমরা এসএসসিসহ অন্যান্য একাডেমিক সার্টিফিকেট দেখতে চাই। কিন্তু আবেদনকারীরা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে থাকলে, সার্টিফিকেটগুলো জমা দিতে চান না। আর এজন্যই বিলম্ব হয়।’

দালালের বিষয়ে আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘দালালদের খপ্পড়ে পড়তে হবে কেন? অনলাইনে আবেদন করবে। আমরা প্রয়োজনীয় যা কাগজপত্র চাইব তা ফিলআপ করবে। শুনানিতে ডাকলে যথাসময়ে চলে আসবে। এরপরও যদি হয়রানি হতে হয় অবশ্যই আমাকে সরাসরি এসে লিখিত অভিযোগ জানাবে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!