চট্টগ্রামে এক্সরের বিপদ এড়িয়ে যাচ্ছে হাসপাতালগুলো, মেডিকেলের মেশিনেই তিনগুণ রেডিয়েশন

এক্সরের প্রায় সব মেশিনই ১৫ বছরের পুরনো

চট্টগ্রামে অধিকাংশ হাসপাতাল ও ল্যাবে মানা হচ্ছে না পারমাণবিক নিরাপত্তা ও বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ (পানিবিনি) বিভাগের নির্দেশনা। এক্স-রে স্থাপনায় বিকিরণ কমানো ব্যবস্থা নেই প্রায় হাসপাতালে। এমনকি এক্স-রে করার সময় টেকনিশিয়ানদের সুরক্ষায় টিএলডি ব্যাজসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ব্যবহার বাধ্যতামূলক হলেও এসব হাসপাতালে এর ছিটেফোঁটাও নেই। অনেকে জানেনই না, কী কী সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হয়। আর এতে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এক্স-রে বা সিটিস্ক্যান রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কারও শরীরে রেডিয়েশন প্রবেশ করলে ভবিষ্যতে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার কোনও কারণে যদি কেউ নিয়মিত এক্স-রে করেন, তার শরীরে রেডিয়েশন প্রবেশ করে চোখে ছানিপড়া, ক্যান্সার, গর্ভপাত, বন্ধ্যাত্ব, মাথার চুল পড়াসহ নানান জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। এমনকি গর্ভাবস্থায় এটি হলে গর্ভস্থ শিশু বিকলাঙ্গ কিংবা প্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন মো. ইলিয়াস চৌধুরী বিভিন্ন ল্যাব, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অভিযান চালাচ্ছেন নিয়মিত। অভিযানে এমন চিত্র দেখা গেছে, অধিকাংশ ল্যাব, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালগুলোতে। এসব ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এক্স-রে রুমে কোনো লিডশিট দেখা যায়নি। রেডিয়েশন নির্গমনের জন্য নেই পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থাও। আবার অনেক জায়গায় এক্স-রে রুমের পরিবেশ দেখা গেছে নোংরা।

শুধু এসব ল্যাব বা হাসপাতাল নয়, চট্টগ্রামের মানুষের সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালেও এক্স-রে বিভাগের বেহাল দশা। হাসপাতালের ১৫ নম্বর রেডিওলজি ও ইমেজিং ওয়ার্ডে এক্স-রে ব্যবস্থাপনায় আইন পালনের ছিটেফোঁটাও নজির নেই।

বুধবার (৩১ আগস্ট) সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের বেহাল দশা। রেডিওলজি বিভাগে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ রোগী এক্স-রে করে থাকেন। এছাড়া এখানে সিটিস্ক্যান, আলট্রোসানোগ্রাফি ও এমআরআই করা হয়ে থাকে। ৫৫ থেকে শুরু করে ৪০০ টাকার মধ্যে এসব সেবা পাওয়ার কথা থাকলে, সেবা নিতে গিয়ে রোগীরা বিকিরণ ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন। অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে এক্স-রে হওয়ায় রোগীরা থাকছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। ওয়ার্ডের এক্স-রে রুমে বিকিরণ ঝুঁকি হ্রাসের কোনো ব্যবস্থা নেই।

জানা গেছে, এক্স-রের জন্য যে মেশিন চালু আছে, তার মেয়াদ চলে গেছে অনেক বছর আগেই। মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট ১৫ জনের জায়গায় কর্মরত আছেন ১০ জন। ক্যাপাসিটির চেয়ে বেশি রোগীর এক্স-রে করানোয় এখানকার মেশিন থেকে বিকিরণ বেশি হচ্ছে। বুকের এক্স-রেতে যেখানে ১৫ এমএস বা মিলি অ্যাম্পিয়ার ও কিলো ভোল্টেজ ৬০ দরকার, সেখানে মেশিন পুরাতন হওয়ায় বিকিরণ আসছে তিনগুণ। আবার অনেক সময় এক্স-রে অবস্থায় মেশিন নষ্ট হয়ে গেলে বিকিরণ বেশি বের হয়ে আসে।

নতুন এক্স-রে মেশিনগুলোতে ১ হাজার এমএ বা মিলি অ্যাম্পিয়ার থেকে ৮০০ এমএ থাকে। কিন্তু মেশিন নষ্ট থাকলে মেশিনের পুরো বিকিরণই বের হয়ে আসে।

১৫ নম্বর ওয়ার্ডের এক্স-রে রুমে গিয়ে দেখা গেছে, এটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়। রুমের দরজা খোলা রেখেই মেশিনে রোগীদের শুইয়ে বা দাঁড়িয়ে এক্স-রে করানো হচ্ছে। ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে ৩০ থেকে ৪০ জন রোগী। কোনো বিকিরণকর্মীর গায়ে নেই টিএলডি ব্যাজ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক্স-রে রুমের এক সিনিয়র টেকনোলোজিস্ট জানান, আমরা কখনোই টিএলডি ব্যাজ পড়িনি। একসঙ্গে অনেকগুলো লোককে আমাদের সেবা দিতে হয়। তাই ব্যাজ পড়েও কোনো লাভ নেই।

এক্স-রে স্থাপনায় বিকিরণ হ্রাসের নির্দেশাবলিতে দেখা গেছে, বিকিরণ ঝুঁকি থেকে বিকিরণকর্মী, জনসাধারণ ও পরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য, পারমাণবিক নিরাপত্তা ও বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯৩ এবং বিধিমালা ১৯৯৭ জারি করা হয়েছে। নির্ধারিত মাত্রার বেশি এক্স-রে সম্পাত বিকিরণ ঝুঁকির কারণ হতে পারে।

বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ আইন বিধিমালা-৯৭ এর বিধি ১৫ অনুযায়ী লাইসেন্স ব্যতীত এক্স-রে স্থাপনা (যেমন এক্স-রে মেশিন, সিটি স্ক্যান, মেমোগ্রাফি, ফ্লোরোকপি, এনজিওগ্রাফি, ডেন্টাল) পরিচালনা করা আইনগত দণ্ডনীয় অপরাধ।

আইনে আরও উল্লেখ আছে, এক্স-রে সম্পাত করতে টিএলডি ব্যাজ ধারণ করা বাধ্যতামূলক। বিকিরণ ঝুঁকি কমানোর জন্য এক্স-রে মেশিন চালানোর সময় কন্ট্রোল বুথ ব্যবহার, লেড, এ্যাপ্রোন, রেড গ্লাভস পরিধানও বাধ্যতামূলক। এছাড়া এক্স-রে মেশিন চলার সময়, দূরত্ব মেনে চলাও বাধ্যতামূলক। একইসঙ্গে কমিশন থেকে প্রাপ্ত লাইসেন্সের কপি এক্স-রে কক্ষের প্রবেশদ্বারে অবশ্যই লাগাতে হবে। আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক্স-রে অপারেটর ছাড়া মেশিন পরিচালনা করা যাবে না।

রেডিয়েশন নির্গমন রুমের দেয়াল ১০ ইঞ্চি ও দরজায় লোহা বা তামার পাতের ব্যবস্থা রাখারও নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু মানা হয় না সেই নির্দেশনাও।

আইন মানাতো দূরের কথা, চট্টগ্রামের অধিকাংশ ডিজিটাল এক্স-রে ল্যাবের লাইসেন্স নেই। মেশিনগুলোও কেনা হয়েছে ১০ থেকে ১৫ বছর আগে। নগরীর সিএসসিআর, শেভরণসহ হাতেগোনা কয়েকটি ল্যাবে বিকিরণকর্মীরা বিকিরণ থেকে আংশিক ঝুঁকি হ্রাসের মধ্যে থাকলেও আইন পুরোপুরি মেনে চলেন না বলে জানা গেছে। এসব ল্যাবের এক্স-রে রুমের দরজা সবসময় খোলা থাকে। সেই সঙ্গে বিকিরণকর্মীদের গায়ে থাকে না এ্যাপ্রোনও।

নগরীর মডেল ল্যাব, কোয়েস্ট, লাইফ কেয়ার, মিনি ল্যাব, আলট্রা আ্যাসে, চেকআপসহ প্রতিষ্ঠিত ল্যাবগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, এসব ল্যাবের কেউই আইন মানেন না। ল্যাবের এক্স-রে রুমের দরজায় আইনি নির্দেশনা লাগানো নেই।

একইসঙ্গে চট্টগ্রামের প্রত্যেকেটি উপজেলার ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর চিত্রও একই।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন মো. ইলিয়াস চৌধুরী বলেন, ‘টিএলডি ব্যাজ পড়া বাধ্যতামূলক এজন্য যে, একজন রেডিওগ্রাফারের গায়ে রেডিয়েশন লাগলে তা এ ব্যাজে সংরক্ষিত থাকে। এ ব্যাজ রেডিয়েশন শুষে নেয়। আমরা ক্রমান্বয়ে নগরীর সব ল্যাব, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিক হাসপাতালের এক্স-রে ব্যবস্থাপনা দেখব। অনিয়ম পেলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হবে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!